অন্যের জন্য ভালো কিছু করতে পারাটাও তোমার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

— গৌতম বুদ্ধ

দিনগুলি রাতগুলি ।। শঙ্খ ঘোষ

[ ইভাকে ]
৭ জানুয়ারি। রাত্রি
হে আমার সুনিবিড় তমস্বিনী ঘনভার রাত্রি, আমাকে হানে।।
ঐ তার আলুলায়িত বেদনার কালো, তারই চুপে দীর্ঘকাল এ আমার স্নান, বন্ধমোহ গতশ্বাস আলুথালু বাঁচা-
কী লাভ কী লাভ তাকে অবিশ্রাম ক্লীবত্বের জালাময় দৈন্যে পুঞ্জ ক’রে ? কিংবা তাকে মহরের শিখরে ছুটিয়ে নিয়ে অবশেষে নির্বাধ প্রপাতে অন্তহীন অন্তহীন অন্ধকারে বিসর্জন করে
কী লাভ কী লাভ?
তাই
এমন আকাশ হবে তোমার চাষের মতো ভাষাহীন নির্বাক পাথর, দৃষ্টি তার
স্থির হবে মৃতের প্রাণের মতো উদাসীন নির্মম শীতল, তুমি আছো সর্বময় রাত্রির
গহনে মিশে—আমি এক ক্লান্তির কাষ্টনে, তুমি যদি মৃত্যু আনো অবসাদে যুক
আর কঠিন কুটিল রাত্রি জুডে
হে আমার তমস্বিনী মর্মরিত রাত্রিময় মালা,
মৃত ফুলে বেদনার প্রাণদাহী ফুলে ফুলে হে আমার উদাসীন মালা, আমার জীবন তুমি জর্জরিত করো এই দিনে রাত্রে দুপুরে বিকেলে এবং আমাকে বলো, ‘মাটির প্রবল বুকে মিশে যাও তৃণের মতন’ : আমি হব তাই
তৃণময় শান্তি হব আমি ।

৮ জানুয়ারি। সকাল
ধীরে, আরো ধীরে সূর্য। উঠো না উঠো না। আবার প্রভাত হলে
পৃথিবী উন্মুখ হবে, রৌদ্র হবে ব্যাধের মতন। আমাকে হানবে তারা বড়ো ! তার চেয়ে তমস্বিনী রাত্রি ভালো আজ, তামসীরে মেরো না মেরো না- ধীরে, আরো ধীরে সূর্য। উঠো না উঠো না ।
৮ জানুয়ারি। দুপুর
হাহাতপ্ত জ্বালাবাষ্প দিনের শিয়রে কাঁপে হৃদয় আমার ।
আকাশ, প্রসন্ন হও। রৌদ্রহর মেঘে মেঘে ঝক্কাকালো করে। দিগঞ্চল — দীর্ঘ করো তামসগুণ্ঠন। আমাকে আবৃত করো ছায়াস্তৃত একখানি ধূসর-বাতাস- ঢালা অকরুণ আলোর মালায়, আমাকে গোপন করো তুমি ।

৮ জানুয়ারি। রাত্রি
আকাঙ্ক্ষা উন্মত্ত হয়, প্রেমের বিষাণে তারা ছুটে ছুটে মাথা কুটে মরে, ভরে
কাপে দূর-দূরান্তর।
কত বলি, কত ভালোবেসে মৃদু স্বরে-সুরে বলি তাকে, র দূরন্ত চোখ, স্পর্শ তাকে ক’রো না ক’রো না। সে তবু শোনে না। বারংবার ঘুরে ঘুরে একই বৃত্তে অস্ত্রহীন সে পয়েছে শুধু একখানি
অবসন্ন দীন ছায়ামাখা ভারি কপণ আকাশ
সেই তার ভালো ।
কত বলি শানে। তুমি অনকাশহারা গূঢ় বাধায় আর চিত্ত, শোনো। লজ্জার আনীল বিষে মুখ তুমি ঢেকো না ঢেকো না। সে তবু শোনে না। বারংবার ঘুরে ঘুরে একই বৃত্তে অবিরাম সে এনেছে একখানি শুধু
যন্ত্রণার ভালা
সেই তার ভালো ।
৯ জানুয়ারি। সকাল
‘এখানে ঘুমায় এক মানবহৃদয়, তার জলে লেখা নাম। ‘
কবিদের, কেবল বেদনা – আহা কেবল বেদনা বুঝি ভালোবাসে তোমার হৃদয় !

মাটির শীতল স্পর্শে অবিরাম অবিরাম কবর কামনা করো তাই ? কতদিন মুঠো মুঠো এমন প্রভাত তুমি ধরেছ কিশোর ? কতদিন সূর্য থেকে মাটি থেকে শূন্য থেকে ধরেছ আকুল মনোভারে একখানি শিথিল প্রণয় ?
অবশেষে একদিন জলে-লেখা- নাম কবি মাটির বাসরে ঘুম রচে।
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না ।
বেদনার শাদা ফুলে আকাশ নিবিড় হবে, অবকাশে ভ’রে যাবে প্রাণ । অবশ বিরামভরা এ পদচারণা তার পুঞ্জ হবে ভাষার আলোকে। আকুঞ্চিত দুটি হাতে
আঙুলে আঙুলে তুমি টেনে নেবে গান—
অবশেষে থরে থরে কথার কাকলি তুলে বীথিকুঞ্জ সাজাবে প্রণয়ী, উচ্চকিত পৃথিবীর দুর্বার প্রতাপ তুচ্ছ ক’রে, কবিতার লেখে-লেখে সুন্দর-আশ্লেষ ধন্য
মেঘকুঞ্জ কথার প্রণয়ী
রাত্রির ‘আবেশে মগ্ন হবে–
তবু সে প্রমের রাত্রি তার!
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না ।

১১ জানুয়ারি। দুপুর
সুন্দর কবিতা সখী!
যখন বিষণ্ণ তাপে প্রধূম গোধুলি তার করুণাবসন ফেলে সূর্যমুখী পৃথিবীকে ঢাকে, কঠিন বিলাপে কাপে উপশিরা-শিরা, জ্যোতিষ্কলোকের রূপসীরা একে একে ছিন্ন করে দয়িত-আকাশ, যখন প্রেমের সত্য ভুবনে ভুবনে ফেরে করুণ লেখায়, তুমিও আসন্ন চন্দ্রে মেলে দাও হৃদয় তোমার, আমি থরোথরো শীতে যন্ত্রণার শিখা মেলি আতপ-তির্যক, যখন পৃথিবী কাপে মৃততেজা মুঠোতে আমার—
তখন কবিতা মিতা, প্রিয় থেকে প্রিয় সখী, সুহৃদ, সুন্দর !
জলের ডালায় যদি হৃদয় প্রসার করি, তোমারই বিকাশ।

তখন কবিতা মিতা প্রিয় থেকে প্রিয় সখী সুহৃদ সুন্দর !
কবি রে, তোর শূন্য হাতে
আকাশ হবে পূর্ণ—
উদাস পাগল গভীর সুরে
ডাক দে তারে ডাক দে !
ভাঙতে কাকন, ছিঁড়তে বাধন
কুলোয় না তার সাধ্যে
কবি রে, আজ প্রেমের মালায় ঢেকে নে তোর দৈন্য !

বহে। রে
আলোর মালা
অবশা
রাত্রি ঘিরে
মেঘের ওই
আকাশ ছিঁড়ে
ঝরে রে
বেদন-সুরা
কবিতা
কল্পলতা
আকুলা
চঞ্চলতা
বাঁধে রে
যন্ত্রণা তার
রাধে সে
গগনে
তমস্বিনী ॥
বহো রে
আলোর মালা
দাও ছড়িয়ে
দহনে
দক্ষ ক’লে
হৃদয়ে
ঝিলিক করো-
মেঘে কে
জাগছ তুমি
জাগো কে
শূন্যপুরে ?
কবিতা
সূর্যলতা
হৃদয়ে
চক্ষে জলে ।
বহো রে
আলোর মালা
তামসী
কণ্ঠ জুড়ে—
তবু কে
কাছে সুরে ?
কবি কি
কবি, সে
নিতা কাঁদে
আকাশে
বড়ো রে
আলোর মাল।
১২ জানুয়ারি। রাত্রি
ছেডো রে
নিতা কাঁদে ?
নিত্য বেদন :
কালোর বাধন ॥
বাসনা-বিদ্যুতে তুমি চিন্ন করো চরিত্রের মেঘ। প্রভূত-আবেগ-পুঞ্জ চেতনার

বৃষ্টি করো আলুথালু প্রকৃতির মুখে। রজনী শাঙন-ঘন, জীবন ময়ূর, দুঃখ কাঁপে
দুর্বল দারুন । প্রেমের বিকীর্ণ শাখা ফুলে-ফলে জ্বলে। জেগে ওঠে ধীরে ধীরে একখানি তপ্তহত পরিপূর্ণ মুখ। রাত্রির কলস ভেঙে প্রভাত গড়ায় দিকে দিকে ।

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0