আত্মীয়-স্বজনকে তার প্রাপ্য দেবে৷ -17:26

— আল কোরআন

শরীফ থেকে শরিফা হয়ে ওঠার গল্প

শরীফা

শরীফা বললেন, যখন আমি তোোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং অবাক
হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে? শরীফা বললেন, আমি তখনও যা ছিলাম এখনও তাই
আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ওরা শরীফার কথা যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারল না।
আনাই তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোোথায়? শরীফা বললেন, আমার বাড়ি বেশ কাছে। কিন্তু আমি
এখন দূরে থাকি। আনাই মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, আমার পরিবার যেমন অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছে,
আপনার পরিবারও তেমনি এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। শরীফা বললেন, তা নয়। আমার পরিবার
এখানেই আছে। আমি তাদের ছেড়ে দূরে গিয়ে অচেনা মানুষদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। এখন সেটাই
আমার পরিবার। তাদের অবাক হতে দেখে শরীফা এবার নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলেন।

শরীফার গল্প

ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের
মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোোবাসতাম। কিন্তু
বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না। বোনদের সাজবার জিনিস দিয়ে লুকিয়ে
লুকিয়ে সাজতাম। ধরা পড়লে বকাঝকা, এমনকি মারও জুটত কপালে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার
বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা
আমার কথাবার্তা , চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়া-পড়শি এমনকি বাড়ির লোকজনও
আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম একথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে
ভীষণ একা লাগত।
একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই
মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই,
আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)। সেই মানুষটা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে
নারী-পুরুষের বাইরে আরও নানা রকমের মানুষ আছেন। তাদের বলা হয় ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী। তাদের
সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো
না যে আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়ম-কানুন, ভাষা,
রীতিনীতি আমাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা। আমরা সবার সুখ-দুুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের
মতনই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয়। তাই মাঝে মাঝে বাড়িতেও যাই।

আজ থেকে বিশ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছি। সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে শহরের
বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো
কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। আমাদেরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক
মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। এখনও বেশির ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে
মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না। তবে আজকাল অনেক মানুষ আমাদের প্রতি যথেষ্ট
সহানুভুতিশীল। ইদানীং আমাদের মতো অনেক মানুষ নিজ বাড়িতে থেকে লেখা পড়া করছে।
আমাদের মতো মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। অনেক দেশেই তারা সমাজের বাকি মানুষের মতনই
জীবন কাটায়। তবে আমাদের দেশের অবস্থারও বদল হচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে। শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, কর্মসংস্থানের
ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রচেষ্টা নিচ্ছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী রানী চৌধুরী,
বিপুল বর্মনের মতো বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে
সাফল্য পেয়েছেন।

শরীফ থেকে শরিফা গল্প shorif theke sharifa golpo

নতুন প্রশ্ন
ওরা এতদিন জানত, মানুষ ছেলে হয় অথবা মেয়ে হয়। এখানেও যে বৈচিত্রর্য থাকতে পারে, সে কথা ওরা
কখনো শোনেনি, ভাবেওনি। কিন্তু শরীফা আলাদা রকম বলে সবাই তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এমনকি তার
পরিবারের লোকেরাও! শরীফার জীবন-কাহিনি শুনে সবার মন এমন বিষাদে ডুবে গেল যে তাকে আর বেশি
প্রশ্ন করতেও ইচ্ছে করল না।
গণেশ, রনি, আয়েশা, ওমেরা আর নীলা সেদিন বাড়ি ফেরার পথে গল্প করছিল:

গণেশ: তাহলে ছেলে এবং মেয়ে ছাড়াও ভিন্ন রকমের মানুষ হয়।
রনি: আমার মা বলেন, ছোটদের কোনো ছেলেমেয়ে হয় না। বড় হতে হতে তারা ছেলে বা মেয়ে হয়ে ওঠে।
আয়েশা: আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আমাদের সময় ছেলে বা মেয়েদের পোশাক, আচরণ, কাজকর্্ম যেমন
দেখি, প্রাচীন মানুষেরও কি তেমন ছিল? সামনের সময়েও কি এমনটা থাকবে?
রফিক: পৃথিবীর সব দেশে, সকল সম্প্রদায়ে কি ছেলেমেয়ের ধারণা, তাদের চেহারা, আচরণ, সাজপোোশাক
একই রকম?
নীলা: আমার মা আমাকে বেগম রোকেয়ার লেখা একটা গল্প পড়ে শুনিয়েছিলেন। গল্পটার নাম ‘সুলতানার
স্বপ্ন’। সেখানে এমন একটা জায়গা কল্পনা করা হয়েছে যেখানে ছেলে আর মেয়েদের প্রচলিত ভূমিকা
উল্টে গিয়েছে।
চলোো, আমরাও নারী-পুরুষের ধারণা, সমাজে তাদের ভূমিকা আর নিজেদের ভাবনা সম্পর্্ককে বন্ধুদের সঙ্গে
গল্প করি।
ছেলেদের জিনিস-মেয়েদের জিনিস
খুশি আপা এবার বললেন, আজকে আমরা আমাদের ১০টি পছন্দের খেলনার তালিকা করব। সেটি হতে পারে
আমাদের ছোটবেলা এবং এখনকার সময়ের পছন্দের খেলনা।
খুশি আপা আরো বললেন, সেই সাথে ছেলে শিক্ষার্থীরা নিজ বোন/আত্মীয় সর্ম্পকের বোন/ মেয়ে সহপাঠীর ১০টি
পছন্দের খেলনার তালিকা করবে। ঠিক একইভাবে মেয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ ভাই/আত্মীয় সর্ম্পকের ভাই/ ম্পর্্ককে
ছেলে সহপাঠীর ১০টি পছন্দের খেলনার তালিকা করবে।
সবাই মিলে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তালিকা করল। তালিকা করা শেষ হলে খুশি আপা জিজ্ঞেস করলেন,
খেলনাগুলোোতে কোোনোো মিল বা অমিল খুজেুঁ পাচ্ছ?
রাজু বলল, জ্বী আপা আমি আর আমার বোন দুজনই লুডু খেলতে পছন্দ করি।
সানজিদা বলল, আপা আমার ভাইয়ের খেলনার সাথে আমার খেলনার বেশ কিছু অমিল আছে। আমার ভাইয়ের
বয়স চার বছর। সে গাড়ি দিয়ে খেলে। মা বলেছেন আমি ওর মতোো বয়সে পুতুল খেলতাম।
খুশি আপা বললেন, আচ্ছা কখনোো কি ভেবে দেখেছ তোোমরা যখন ছোোট ছিলে তখনতোো তোোমাদের একই
ধরণের খেলনা দিয়ে খেলার কথা ছিল। তোোমাদের খেলনা পছন্দের পার্্থক্্য হলোো কি করে?
রাতুল বললোো, ঠিক আপা ঐ সময়েতোো আমি বুঝতামই না কোোন খেলনা দিয়ে খেলব। আমি দেখেছি আমার
পরিবার ছোোট ভাইকে বল কিনে দিয়েছে আর আমার ছোট বোনকে হাাঁড়ি পাতিল কিনে দিয়েছে। তাইতোো তারা
সেটিকে নিজেদের খেলনা ভেবে খেলেছে।
খুশি আপা বললেন, ছেলে ও মেয়ের শারীরিক বৈশিষ্টট্য ভিন্ন। এই ভিন্নতা হচ্ছে তার লিঙ্গ পরিচয়। আর
চারপাশের মানুষ যখন লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য ছেলে ও মেয়ের কাজ, দায়িত্ব ও ভূমিকার মধ্যে পার্্থক্্য করে দেয়
তখন সেটি হচ্ছে তার জেন্ডার বৈশিষ্টট্য।

shorif theke sharifa golpo

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0