A goal without a plan is just a wish.

— Antoine de Saint-Exupéry

(মাধুকরী” উপন্যাস থেকে সংকলিত)

বুদ্ধদেব গুহ

কুর্চি,
তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীত-সকালে এক রাশ উষ্ণতা বয়ে আনল। পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে, বিবাগী হচ্ছে ভোগী। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের দূতীর মত এল এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসী সমবেত সবুজ চিৎকারের মতো। তার মানে এই নয় যে- তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খুঁত ক্ষমা করে দিও।
কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?
সকাল থেকেই তোমাকে আজ খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুম ভাঙ্গলো বড় এক চমকে। একজোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। যে পাখিদের ডাক বড় একটা শুনিনি এদিকে। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি এক জোড়া স্কালের্ট মিনিভেট এসে বসেছে আম গাছের মাথায়। আমার ঘুম ভাঙ্গানীয়া পাখিরা। আহা! রোজই যদি আসতো।
আর তারপরই তোমার এই চিঠি। দিন আজকে ভাল যাবে আমার।
বলছিলাম যে, সকাল থেকেই তোমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু সুন্দর সুখের যা-কিছু ইচ্ছা তা দমন করার মধ্যেও বোধহয় এক ধরনের গভীরতর সুখ নিহিত থাকে। থাকে না?
আজ চিঠি লিখব না তোমাকে। তার বদলে একটি স্বপ্নহার পাঠাচ্ছি। লেখক, কবি না। তবুও, তার নাম গোপন থাক।
কি যে দেখেছিলাম তোমার ঐ মুখটিতে কুর্চি! এত যুগ ধরে কত মুখইতো দেখল এই পোড়া চোখ দুটি। কিন্তু এমন করে আর কোনোও মুখই তো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেনি। ভালো না বাসলেই ছিল ভালো। বড় কষ্ট গো ভালবাসায়। ভালবাসাতো কাউকে পরিকল্পনা করে বাসা যায় না, ভালোবাসা হয়ে যায়; ঘটে যায়। এই ঘটনা ঘটার অনেক আগে থেকেই মনের মধ্যে প্রেমপোকা কুড়তে থাকে তারপর হঠাৎই এক সকালে এই দুঃখ-সুখের ব্যাধি দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো ধরা পড়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। অমোঘ পরিণতির জন্যে অশেষ যন্ত্রণার সংগে শুধু নীরব অপেক্ষা তখন।
কেউই যেন কাউকে ভাল না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতে এতই গড়িয়ে দেয়। তার সব কিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। অমোঘ পরিণতির জন্যে অশেষ যন্ত্রণার সংগে শুধু নীরব অপেক্ষা তখন। কেউ যেন কাউকে ভাল না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। তার সব কিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। হুঁশ থাকলে এমন মূর্খামী কেউ কি করে? বলো?
সে জন্যেই বোধহয় হুঁশিয়ার মানুষদের কপালে ভালবাসা জোটে না। যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, একমাত্র তারাই ভালোবেসে সব হারাতে পারে। অথবা অন্য দিক দিয়ে দেখলে মনে হয়, যা কিছুই সে পেয়েছিলো বা তার ছিল, সেই সমস্ত কিছুকেই অর্থবাহী করে তোলে ভালবাসা। যে ভালোবাসেনি তার জীবনও বৃথা।
তবুও… বড় কষ্ট ভালোবাসায়।
এমন মহাবোধ আর কি আছে? আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ তোমাকে ভালোবেসে আমার নিজের সস্তা-আমার কাছে কত যে দামী, কত মহার্ঘই যে হয়ে উঠি তা আমিই জানি।
স্বপ্নহার, তোমায় পাঠাই…নীল নদীটির নিবিড় পারে,
ঘুম-পাওয়া রোদ চমকে চেয়ে অলস পায়ে, যখন হাঁটে মাঘী মাঠের ন্যাবা-ধরা শূন্যতাতে ঠিক তখনই আমার বুকের গভীর থেকে স্বপ্নগুলো ঝাপটে ডানা
অস্ফুটে কি কইতে কইতে নড়ে চড়ে!
স্বপ্নগুলো খুব ভীতু হয়, আমার স্বপ্ন; স্বপ্ন সবার।
তবুও আমি স্বপ্ন দেখি। রূপের রাজা, গুণের গুনীন,
মুঠির মাঝে মুক্তো-মলিন, সব পাখিদের মুগ্ধ করা মন্ত্র নিয়ে আসব ফিরে বারে বারে।
আমার কিছু স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন নিয়ে মালা গাঁথি। স্বপ্নমালা।
ছিপছিপে সেই মেয়ে, ছিপছিপে সে। শ্যামলাবরণ, পেঁয়াজ খসি শাড়ি; তার স্বপনপুরে বাড়ি। আমার সংগে আড়ি।
স্বপ্নে-দেখা নারী, প্যাঁচ গুছি শাড়ির আঁচল ঠোঁটের কোণের তিল, স্বপ্ন মালায় গেঁথে গেল হরিণ, চিতা; চিল।
স্বপ্নে আমি ভেবেছিলাম অনেক কিছুই। ভেবেছিলাম, এটা করব, সেটা করব, বাড়ি করব, পাহাড়চূড়োয় স্বপ্ন এবং সুখের কুটো দিয়ে। পায়ের কাছে বইবে নদী, নারীর মত, সাধের নারী, বাধ্যতা আর নাব্যতাতে নীল।
স্বপ্ন ওড়ে! স্বপ্ন ওড়ে বারে বারে।
কুর্চি , দেখি কি করতে পারি? তোমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে তো কত কিছু করে। এ জীবনে ক’টি ইচ্ছে আর পূর্ণ হয় বলো?
কারই বা হয়? এমনিতেই আমার অনেক কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে কষ্ট আর বাড়িও না। একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে। যার বিবেক বেঁচে থাকে; তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক, বিবশ হলেই বাঁচি!
ভালো থেকো,
তোমার পৃথুদা।
“(মাধুকরী” উপন্যাস থেকে সংকলিত)

  • বুদ্ধদেব গুহ।
What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0