অপরকে ঘৃণার চোখে উপহাস করিও না, যেহেতু তাহারা তোমাদের অপেক্ষা ভাল হইতে পারে৷ অপরের ত্রুটি অনুসন্ধান করিও না, এবং একজনের অসাক্ষাতে নিন্দা করিও না৷ আল্লাহকে ভয় কর, যেহেতু আল্লাহ দয়ালু ও ক্ষমাকারী ৷ – 49/11/12

— আল কোরআন

কালো ম্যাম

ফারহান আহমেদ রাব্বী

আমার বেশ মনে আছে,সে দিনগুলোর কথা।
যে দিনগুলোর কথা মনে করতেই,
চোঁখের সামনে তৈলচিত্রের মতো ভেসে ওঠে
অবহেলা,অবজ্ঞা আর শৈশবের কঠোরতা।
ক্লাসে,একমাত্র উপহাসের পাত্র ছিলাম আমি।
অন্যরা ভুল করলে মিলত একতাল সমবেদনা,
সান্ত্বনা আর অটুট আশ্বাস।
আর আমার বেলায়
অতিসামান্য সময়ে এই শুন্য হৃদয়টা পরিপুর্ন হয়ে যেত
তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ এবং উপহাস দিয়ে।
আমি শুধু মাথা নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে তাকতাম।
মাঝে মাঝে-আকাশপানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলতাম
আমার এই করুনতা যদি তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে
তাতে ক্ষতি কি ?
সহজে খেলতো নিতো না কেউ।
আমি সামনে গিয়ে দাড়াতেই,
দুদলের ক্যাপ্টেনের মধ্যে,আমাকে নিয়ে রেশারেশি শুরু হয়ে যেত।
অবশেষে কদাকিঞ্চিত জায়গা মিলত
গোলকিপার কিংবা ফিল্ডার হিসেবে।
বছর দুয়েক পুরনো স্কুল ড্রেসখানা
মজমাসভায় ছিড়ে দিয়েছিল তারা একদিন।
এরপর-টানা সাতদিন আমি স্কুলে যেতে পারিনি।
মাসের পাচ তারিখের মধ্যে
কোনোদিনই মাইনে ফি দিতে পারিনি।
ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম বলে
অর্ধেক বেতনেই দিব্যি জায়গা করে নিয়েছিলাম স্কুলে।
তারপরও প্রতমাসের বেতনের তালিকায়
আমার নামটা সবার শেষেই থাকতো।
ঝন্টু স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন বলে,
মাঝে মাঝে দু-কান ধরে নিয়ে যেতেন।
আসলে বিনা বেতনের টিউশনি নিতে, বেশ
সংকোচবোধই লাগতো।
স্কুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে,যখন
মেধাতালিকায় পুরষ্কার নিতে গেলাম।
বড় স্যার আমার পোশাকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আমি-হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড সেকও করতে পারিনি।
তবে হ্যা।
আমার এই একাকিত্বময় জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল
আমার কালো ম্যাম।
সাহেব বাড়ির বড় মেয়ে-নাম তার শ্যাফালি।
দিনের বেশিরভাগ সময়টা আমার সাথেই কাটতো তার।
প্রতিদিন বিকেলে
সাহেব বাড়ির মালি,মনিতা-দি এসে বলতো
ছোট বাবু বাড়ি আসো
কালো ম্যাম তোমার অপেক্ষায়
চলে এসো।
কেন যে মনিতা-দি আমাকে
ছোট বাবু বলে ডাকতো,
তা তখন বুঝতে পারিনি।
পুরনো সেই বকুল গাছটার নিচে গিয়ে দেখি
কালো ম্যাম-আপনমনে বকুল ফুলগুলো
একখানা সুতোয় আবদ্ধ করছে।
আমি পাশে বসতেই
মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে যেত তার চোখের চাহুনি,
কথা বলার ভঙ্গি।
আমি শুধু চুপ করে শুনে যেতাম।
দিনশেষে একখানা বকুলের মালা হাতে দিয়ে
কালো ম্যাম মুচকি হেসে চলে যেত।
বকুলের মালাগুলো শুকিয়ে যেত ঠিকই
তারপরও আমি সেগুলো যত্ন করে রেখে দিতাম।
যেদিন প্রাথমিক জীবনের সমাপ্তি ঘটল
কালো ম্যাম শহরে যাওয়ার আগে,তার
দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছিল।
সেদিন জীবনের একাকিত্বমাই সময়টাকে
আমি আবার, নতুন করে অনুভব করেছিলাম।
আজ পনেরো বছর পর
কালো ম্যামের সাথে দেখা।
কোনো এক স্টেশনে,আমরা ভিন্ন পথের যাত্রী।
জমানো কথাগুলো বলা হলো না-কোনোদিন।
আবার হারিয়ে গেলো-ছোট্ট বেলার প্রেম
আমার কালো ম্যাম।

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

Leave a Reply