Life is what happens when you’re busy making other plans.

— John Lennon

দেশি পণ্য নিয়ে আমাদের ই-কমার্স: যতদূর যাওয়া সম্ভব

দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় ২০১০ সালের পর থেকেই ই-কমার্সের চাহিদা বাড়তে থাকে। সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার যেন হয়ে উঠে অনলাইন ব্যবসার এক একটি হাব। বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসা তথা ই-কমার্স এর পাঠ ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা স্পষ্ট করে না বলা গেলেও তা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সমকালীন বললে বাড়িয়ে বলা হবেনা। ২০১৬ এর এপ্রিলে ফেসবুক যখন লাইভ এর সুবিধা নিয়ে আসে তখন থেকে অনলাইন ব্যবসায়ীদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অনলাইন ব্যবসা রীতিমতো একটা ট্রেন্ড হয়ে যায়।

প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য যে, ই-কমার্স, ট্রেড, অনলাইন ব্যবসা শুনতে একই রকম মনে হলেও এদের মাঝে একটা সূক্ষ পার্থক্য বিদ্যমান। ট্রেড হলো দুটি দেশের মধ্যে বেচা কেনা। অন্যদিকে, কমার্স হলো কেনাবেচা এবং এর সাথে সম্পক্ত কার্যাবলী। যেমন পণ্যের প্রোমোশন, উদ্যোক্তার ট্রেনিং, ব্যবসায়ের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি। কমার্সের এই কাজগুলো যখন ইন্টারনেট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া নির্ভর হয় তখন তাকে বলি ই-কমার্স।

এখন যেমন অনেকটা সাজানো গুছানো আমাদের ই-কমার্স খাত, ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেশ কিছু মাঝারি থেকে বড় ই-প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এই খাতে, শুরুর দিকে কিন্তু ঠিক তেমনটা ছিলোনা। বরং ই-কমার্স খাতকে পার হতে হয়েছে অনেক চড়াই উৎরাই। ৯০ এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে ই-ক্যাব (ই কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ)। তখন ই-কমার্স শুধুমাত্র ইলেকট্রনিক লেনদেন আর কুরিয়ার সার্ভিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ তখনও অনলাইন ব্যবসার প্রসার ঘটেনি এ দেশে। এদিকে ২০১৩ সাল থেকে ই-ক্যাব তাদের কাজের পরিধি বাড়ায় এবং অনলাইন ব্যবসাকে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে। উদ্দেশ্য ছিলো অনলাইন ব্যবসার গতি সঞ্চার করা। সময়ের সাথে সাথে অনলাইন ব্যবসাকে গতি দেয়ার তাগিদে ই-কেবের উদ্দেশ্যে যুক্ত হয় উদ্যোক্তাদের জন্য ই-কমার্স পলিসি ও গাইডলাইন তৈরি, সহজ সর্তে পণ্য ডেলিভারির ব্যবস্থা, ট্রেইনিং, পণ্যের মানোন্নয়ন ও গবেষণার ব্যবস্থা ইত্যাদি। ২০১৪ তে ই-ক্যাব বাংলাদেশ ট্রেড এসোসিয়েশন এর কাছ থেকে আইনগত স্বীকৃতি পায়। এভাবে ই-ক্যাব এর মাধ্যমে ই-কমার্স ইন্ড্রাস্ট্রিতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। বাংলাদেশে আমদানি নির্ভর ই-কমার্স খাতের গল্পটা মোটামুটি এটুকুই।

এদিকে ২০১৫ থেকেই বেশকিছু নারী উদ্যোক্তা তাদের বানানো দেশী পণ্য নিয়ে অনলাইন ব্যবসায় আসতে শুরু করেন। সে সময় যোগানের তুলনায় দেশী পণ্যের চাহিদা ছিল বেশি। কিন্তু ই-ক্যাবের মতো তেমন কোনো প্লাটফর্ম না থাকায় ব্যবসায় ঝুঁকিও ছিল উল্লেখ করার মতো। প্রয়োজন পড়ে দেশী পণ্য নির্ভর ই-কমার্স খাতের। ২০১৭ সাল, সুবিশাল নারী উদ্যোক্তার কথা চিন্তা করেই ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজীব আহমেদ গড়ে তোলেন নতুন আরেকটি সংঘটন ‘উই’ (ওমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম)। মানুষকে ই-কমার্স সম্পর্কে সচেতন করাই ফোরামের মূল উদ্দেশ্য, আর পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন তো আছেই।

প্রশ্ন আসতেই পারে কেন দেশী পণ্যের জন্য আলাদা ই-কমার্স খাতের দরকার পড়ল?দরকার পড়ল আলাদা এসোসিয়েশনের? আমি বলব দুটো কারণে এই পরিবর্তনের দরকার ছিল, এক. এই খাতটি অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। দুই. সম্ভাবনার পাশাপাশি এই খাতে রয়েছে বেশকিছু সমস্যা।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ই-কমার্সের বাজার ছিল প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা, যেটা ২০১৮ তে ৩০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি চলে যায়। বর্তমানে দেশে ই-কমার্স উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজারের মতো। ঢাকায় এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হলেও অন্য জেলা শহরগুলোতে এর পরিমাণ নেহাৎ কম নয়। বাংলাদেশে দেশী পণ্যের ই-কমার্স খাতটি অনেক সম্ভাবনাময়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পণ্যের গুনাগুন। যদিও অনেকেই অনলাইনে কেনা পণ্যের গুনাগুন নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, কিন্তু আমি মনে করি এই পণ্যগুলোকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে। কারণ এই খাতের উদ্যোক্তাদের ভেতর ক্রেতা ধরে রাখার তীব্র আকাংখা কাজ করে। আগে দেশীয় পণ্যের উৎস বলতে ‘আড়ং’ কিংবা এমন কিছু এনজিও সাহায্যলব্ধ প্রতিষ্ঠানকে বুঝতাম। কিন্তু এখন দেশীয় ই-কমার্স খাত আড়ং এর বিকল্প হতে চলেছে।

দেশীয় পণ্যের এই বাজারে বিভিন্নতা অনেক বেশি। বড় ও ছোটদের পোশাক, হাতে বানানো অলংকার, শুকনো খাবার, শুটকি মাছ, মশলা, দুগ্ধজাত পণ্য, রকমারি মিস্টি, ঘর সাজানোর উপকরণ, তৈজষ্পত্র, পেইন্টিং – কি নেই এই সেক্টরে! ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকেই বলছি, ক্রেতাদের যদি একবার এই সেক্টরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় তাহলে বিদেশী পণ্যের প্রতি ক্রেতার আগ্রহ অনেকটাই কমে যাবে। বিকাশ, রকেটে মানি ট্রান্সফার ই-কমার্স সাফল্যের বড় একটা নিয়ামক। অনলাইন ব্যাংকিং এর সেবার ফলে এখন ঘরে বসেই নিশ্চিন্তে টাকা ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে অর্থের আদান প্রদান সহজ হয়েছে।

প্রতিদিনই আমাদের এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। এক হিসেবে দেখা গেছে, প্রতি ঘন্টায় গড়ে পাচজন উদ্যোক্তা যুক্ত হচ্ছে ইন্ড্রাস্ট্রিতে। এর ফলে শুধু যে একজন উদ্যোক্তারই কর্মসংস্থান হচ্ছে তা কিন্তু নয়, বরং ব্যবসার সাথে জড়িত ডেলিভারি বয়, সম্পর্কিত পণ্য প্রস্তুতকারীদেরও কাজের সু্যোগ সৃস্টি হচ্ছে। আবার ওয়েবসাইট ব্যবহার করে পণ্য প্রোমোশন এর ফলে ওয়েব ডেভেলপারেরও চাহিদা বাড়ছে।

দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ই-কমার্সের সম্ভাবনা থাকলেও সবাই কিন্তু এটাকে কাজে লাগাতে পারছেনা। অথবা কিছুদিন কাজ করে সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে ঝরে পরছে।

বাজার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব, এ সেক্টরের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। বড় বড় শহরগুলোর পাশাপাশি দেশী ই-কমার্সের সাফল্য গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক উদ্যোক্তাকেই আকর্ষণ করছে। কিন্তু বাজার সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে অনেকসময় বুঝতে পারেনা কি ধরনের দাম রাখা উচিত।

আমাদের ই-কমার্স এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক নির্ভর। ব্যবসায়ের শুরুতে এই নির্ভরতা প্রাসঙ্গিক হলেও ব্যবসা যত বড় হবে শুধুমাত্র এটার উপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকির কারণ হতে পারে। ২০১৫ সালের দিকে সরকারিভাবে ফেসবুক ১৫ দিন বন্ধ রাখা হয়, এ সময় ই-কমার্স যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। এছাড়া, হ্যাকার এর ভয়, যান্ত্রিক ত্রুটি তো রয়েছেই। আবার, ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতার অভাব এবং আইটি জ্ঞানের অভাবে উদ্যোক্তারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে বাধার সম্মুখীন হয়। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য প্রয়োজন, যেমনঃ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যথাযথভাবে গুছিয়ে না রাখা, লাভ লোকসানের হিসেব না করতে পারা, কোম্পানির নামে ব্যাংক একাউন্ট না থাকা ইত্যাদি। তবে শুরু থেকেই যদি এসব ব্যপারে না জানা থাকে তাহলে পরে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট এবং হোম ডেলিভারি ই-কমার্সের সাফল্যের মূলমন্ত্র। ঢাকা, চট্রগ্রাম এ দুটি বড় শহর বাদে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও হোম ডেলিভারি কল্পনার মতোই। এক্ষেত্রে বিক্রেতাকে পণ্য আদান-প্রদানের জন্য কুরিয়ারের উপর নির্ভর করতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়, সময় বেশি লাগে এবং অনেকসময়ই পণ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

২০১৮ এর মাঝামাঝিতে চায়না জায়ান্ট আলীবাবা যখন দারাযকে কেনার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন হয়তো অনেকেই ধারণা করেছিলো বাংলাদেশের ই-কমার্স ঘুরে দাড়াতে পারবেনা, তার উপর এটা যদি হয় দেশী পণ্য নিয়ে । বর্তমানে ৮২.৭০ মিলিয়ন নারী দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে, যাদের মধ্যে ৫৭% নারীর কাজই ঘরের বাইরে। অন্যদিক, দেশের ই-কমার্স সেক্টরে ৯৮% ই নারী উদ্যোক্তা, কারণ একমাত্র এই খাতেই রয়েছে সংসার সামলিয়ে কাজে সফল হওয়ার সুযোগ। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার নারী উদ্যোক্তা অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

তবে একটি খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে আন্তর্জাতিক বাজার প্রসারের লক্ষ্যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা এধরনের প্রতিষ্ঠানের সহায়তার পাশাপাশি সরকারকেও আরও বেশি সচেতন হতে হয়। ভালো উদ্যোক্তাদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা, দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অংগনে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রয়ের সুযোগ করে দেয়া, ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণের যোগান ইত্যাদি হতে পারে সরকারের পক্ষ থেকে দেশী পণ্য নির্ভর ই-কমার্সের জন্য অনেক বড় উপহার। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ই-কমার্স বিষয়ক গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি ই-কমার্সের সাফল্য পরিমাপের একটি বড় হাতিয়ার। অবশ্যই এটার দিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে।

Maksuda Hossain

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

Leave a Reply