Tag: কবিতা

  • নাবিক -জীবনানন্দ দাশ

    কবে তব হৃদয়ের নদী
    বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি!
    সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে
    দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে
    বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন!
    -পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন!
    কারাগার-মর্মরের তলে
    নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে
    ভ’রে যায় বসুধার আহত আকাশ!
    অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!
    -সহস্রের অঙ্গুলিতর্জন
    নিত্য সহিতেছি মোরা,-বারিধির বিপ্লব-গর্জন
    বরিয়া লয়েছ তুমি,- তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;
    তোমার পঞ্জরতলে টগ্‌বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!-
    তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার,
    অবগুণ্ঠিতার
    হিমকৃষ্ণ অঙ্গুলির কঙ্কাল-পরশ
    পরিহরি গেলে তুমি,-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস
    তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা
    চকিতে চূর্ণিয়া গেলে,-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা
    বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,
    তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট
    তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!
    নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!
    প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!
    ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,-
    অগাধের সাধ
    তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ!
    মণিময় তোরণের তীরে
    মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে
    নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে
    হে দুরন্ত দুর্নিবার,-প্রাণ তব কাঁদে!
    ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন,
    সমুদ্রের যৌবন-গর্জন
    তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর- শের!
    টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের
    হে জলধি পাখি!
    পক্ষে তব নাচিতেছে লক্ষ্যহারা দামিনী-বৈশাখী!
    ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রত্নচূড় ময়ূখের টিপ,
    কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ
    করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে!
    বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে
    সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে!
    কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে,-
    স্তম্ভিত নয়নে
    নীল বাতায়নে
    তাকায়েছ তুমি!
    অতিদূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের
    আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি
    সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী!
    সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি
    আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া
    হে জল-বেদিয়া!
    অলক্ষ্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন
    সিন্ধু- বেদুঈন!
    নাহি গৃহ- নাহি পান্থশালা-
    লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা
    তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্য-পাতালে-
    বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে!
    প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!
    সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছু-ডাকা স্বর,
    ভুলেছ নোঙর!
    কোন্ দূর কুহকের কূল
    লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল
    কে বা তাহা জানে!
    অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!
    ✍✍✍✍✍
    নাবিক

    • জীবনানন্দ দাশ—✍✍✍✍
  • তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি

    তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি
    তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো বেশি গভীরে জড়াই,
    যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই দূরে
    ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি
    তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
    এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
    তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ জড়িয়ে যাই আমি
    আমার কিছুই আর করার থাকে না
    তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে যেতে চাই
    যদি ডুবে যেতে চাই তুমি দুহাতে জাগাও।
    এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের সামান্য আড়াল হই,
    দুই হাত দূরে যাই
    যেখানেই যেতে চাই সেখানেই বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
    তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
    তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
    আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার ভেতরে জেগে আছো।
    তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো বেশি
    ভালোবেসে ফেলি,
    তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নেই
    যতোই তোমার কাছ থেকে আমি দূরে যেতে চাই
    ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে,
    ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার মতন;
    কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও জায়গা থাকে না
    তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
    তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আরো জড়িয়েছি
    তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো ভালোবেসেছি তোমাকে।


    তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি – মহাদেব সাহা

  • জগতের আনন্দযজ্ঞে

    বেশ জমাটি আড্ডায় বসে আছ ধুরন্ধর প্রেমিক পুরুষ
    তােমার বন্দরে প্রতিদিন ভিড়ছে জাহাজ।
    তােমার কার্গোয় চমৎকার উপচে পড়ছে
    সােনাদানা, নিষিদ্ধ গন্দম
    তােমার কী দরকার নাড়াচাড়া করে
    কবে কোন কিশােরীর বুক থেকে খুলেছিলে প্রথম শরম;
    কবে তার দরজা-দালান ভেঙে এনেছিলে ঝড়,
    কৌটোর মােহর নিয়ে হঠাৎ পালিয়েছিলে।
    স্মৃতি যদি ঠোটে করে খড়কুটো দুঃখ বয়ে আনে, তাই
    কী দরকার নাড়াচাড়া করে
    কবে কিশােরীকে একলা আঁধারে রেখে
    প্রমােদে শরীর ঢেলেছিলে,
    বধূটির বিষণ্ণতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
    গােপনে সুখের কথা বলেছিলে।
    তুমি তাে হে বেশ আছ।জাহাজ ভিড়ছে
    বন্দরে নিয়ত কোলাহল, ভিড়।
    কে যে একলা কোথায় কাঁদে, স্মৃতির সুতােয়
    কে যে সমস্ত বিকেল গেঁথে রাখে কষ্টের বকুল
    তুমি তার কিছুই জানাে না।
    তসলিমা নাসরিন

  • বোধ -জীবনানন্দ দাশ

    আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
    স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
    স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
    হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
    আমি তারে পারি না এড়াতে,
    সে আমার হাত রাখে হাতে,
    সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
    সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
    শূন্য মনে হয়,
    শূন্য মনে হয়।

    সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
    কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
    সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
    কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
    কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
    কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
    সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
    সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
    স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
    শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
    শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
    উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
    চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
    কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
    স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
    মাথার ভিতরে।
    পথে চ’লে পারে—পারাপারে
    উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
    মড়ার খুলির মতো ধ’রে
    আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
    তবু সে মাথার চারিপাশে,
    তবু সে চোখের চারিপাশে,
    তবু সে বুকের চারিপাশে;
    আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।

    আমি থামি—
    সেও থেমে যায়;

    সকল লোকের মাঝে ব’সে
    আমার নিজের মুদ্রাদোষে
    আমি একা হতেছি আলাদা?
    আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
    আমার পথেই শুধু বাধা?

    জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
    সন্তানের মতো হ’য়ে—
    সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
    যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
    কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
    যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
    জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
    তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
    আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
    আমার মনের মতো না কি?
    —তবু কেন এমন একাকী?
    তবু আমি এমন একাকী।
    হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
    বাল্‌টিতে টানিনি কি জল?
    কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
    মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
    ঘুরিয়াছি;
    পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
    গিয়েছে জড়ায়ে;
    –এই সব স্বাদ;
    —এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
    বয়েছে জীবন,
    নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
    এক দিন;
    এই সব সাধ
    জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
    চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
    ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
    অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
    ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;

    আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
    আসিয়াছে কাছে,
    উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
    ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
    ভালোবেসে তারে;
    তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
    আমি তার উপেক্ষার ভাষা
    আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
    অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
    আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা

    আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
    তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।

    মাথার ভিতরে
    স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
    আমি সব দেবতারে ছেড়ে
    আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
    বলি আমি এই হৃদয়েরে:
    সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
    অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
    কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
    পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
    মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
    মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
    শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!

    এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
    পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
    পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
    চায় না সে? করেছে শপথ
    দেখিবে সে মানুষের মুখ?
    দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
    দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
    চোখে কালো শিরার অসুখ,
    কানে যেই বধিরতা আছে,
    যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
    নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে,
    যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
    —সেই সব।

  • মৃত্যুর আগে -জীবনানন্দ দাশ

    আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
    দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
    কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
    তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
    জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
    চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

    আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
    খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
    পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
    বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
    গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
    আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;

    আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
    এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
    আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত,
    সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
    শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
    আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;

    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
    হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
    ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
    চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা
    নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
    পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে;
    মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
    বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে,
    নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে,
    খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে;
    বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
    নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;

    আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল
    পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;
    যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
    পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;
    আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,
    প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ;

    আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর
    পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
    ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
    আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;
    চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:
    পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;

    আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
    সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
    ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
    নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
    কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
    শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!

  • সেদিন এ-ধরণীর

    সেদিন এ-ধরণীর
    সবুজ দ্বীপের ছায়া—উতরোল তরঙ্গের ভিড়
    মোর চোখে জেগে-জেগে ধীরে-ধীরে হ’লো অপহত
    কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো।
    দিকে-দিকে ডুবে গেল কোলাহল,
    সহসা উজানজলে ভাটা গেল ভাসি,
    অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি
    বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার।

    সেইদিন মোর অভিসার
    মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
    বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
    ভেসেছিলো আতুর উদাসী;
    বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
    কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি
    সেদিন শুনিনি তাহা;
    ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
    অতিদূর তারকার কামনায় আঁখি মোর দিয়েছিনু খুলে।

    আমার এ শিরা-উপশিরা
    চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন,
    শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন—
    মোর তরে পিছু ডাক মাটি-মা—তোমার;
    ডেকেছিলো ভিজে ঘাস—হেমন্তের হিম মাস—জোনাকির ঝাড়,
    আমারে ডাকিয়াছিলো আলেয়ার লাল মাঠ—শ্মশানের খেয়াঘাট আসি,
    কঙ্কালের রাশি,
    দাউ-দাউ চিতা,
    কতো পূর্ব জাতকের পিতামহ পিতা,
    সর্বনাশ ব্যসন বাসনা,
    কতো মৃত গোক্ষুরার ফণা,
    কতো তিথি—কতো যে অতিথি—
    কতো শত যোনিচক্রস্মৃতি
    করেছিলো উতলা আমারে।
    আধো আলো—আধেক আঁধারে
    মোর সাথে মোর পিছে এলো তা’রা ছুটে,
    মাটির বাটের চুমো শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে, রোমপুটে;
    ধুধু মাঠ—ধানখেত—কাশফুল—বুনো হাঁস—বালুকার চর
    বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
    এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া;

    মাঝপথে থেমে গেল তা’রা সব;
    শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
    দূরে—দূরে—আরো দূরে—আরো দূরে চলিলাম উড়ে,
    নিঃসহায় মানুষের শিশু একা—অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
    অসীমের আঁচলের তলে
    স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
    উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে—
    দূর ছায়াপথে।
    পৃথিবীর প্রেতচোখ বুঝি
    সহসা উঠিল ভাসি তারকাদর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি;
    ভ্রূণভ্রষ্ট সন্তানের তরে
    মাটি-মা ছুটিয়া এলো বুকফাটা মিনতির ভরে;
    সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু—বৃদ্ধ মৃত পিতা,
    সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা,
    মোর পাশে দাঁড়ালো সে গর্ভিণীর ক্ষোভে;
    মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
    কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন—জননীর প্রাণ;
    জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান
    তার তরে কালে-কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা শালতমালের ছায়া,
    এনেছে সে নব-নব ঋতুরাগ—পউষনিশির শেষে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া;
    তার তরে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
    মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার ভিজে রসে উঠিয়াছে ভরি,
    উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
    মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী;
    মশলাদরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে—
    কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু অমানিশা
    দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
    নয়ন মুদিনু ধীরে—শেষ আলো নিভে গেল পলাতক নীলিমার পারে,
    সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।

    জীবনানন্দ দাশ
    জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা

  • পিরামিড

    বেলা ব’য়ে যায়,
    গোধূলির মেঘ-সীমানায়
    ধূম্রমৌন সাঁঝে
    নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে,
    শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে;
    পান্থ ম্লান চিতার কবলে
    একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ;
    কার লাগি, হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছো আজ—
    কি এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন!
    অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
    চকিতে মিলায়ে গেছে পাও নাই টের;
    কোন্ দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
    দেউটি নিভায়ে গেছে—চ’লে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
    চ’লে গেছে প্রিয়তম—চ’লে গেছে প্রিয়া
    যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
    চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী
    কবে কোন বেলাশেষে হায়
    দূর অস্তশেখরের গায়।
    তোমারে যায়নি তা’রা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া;
    সাঁঝের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া
    মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী,
    তোরণে আসেনি তব লক্ষ-লক্ষ মরণ-সন্ধানী
    অশ্রু-ছলছল চোখে পাণ্ডুর বদনে;
    কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তা’রা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
    জানো নাই তুমি;
    জানে না তো মিশরের মুক মরুভূমি
    তাদের সন্ধান।
    হে নির্বাক পিরামিড,—অতীতের স্তব্ধ প্রেতপ্রাণ,

    অবিচল স্মৃতির মন্দির,
    আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি ব’সে আছে স্থির;
    নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে
    চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে
    মেঘরক্ত ময়ূখের পানে,
    জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে
    নূতন ভাস্কর;
    বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
    নবোদিত অরুণের সনে—
    কোন্ আশা-দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে!
    পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু-দণ্ডের রুধিরফোয়ারা—
    কী এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া!
    থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন;
    শতাব্দীর বিরহীর মন
    নিটল নিথর
    সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত পীত সাগরের ’পর;
    বালুকার স্ফীত পারাবারে
    লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে
    মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি’
    মৌন ভিক্ষা মাগি।
    খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার
    মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
    ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায়—
    বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই ব’সে আছে পিরামিড হায়।
    কতো আগন্তুক কাল অতিথি সভ্যতা
    তোমার দুয়ারে এসে ক’য়ে যায় অসম্বৃত অন্তরের কথা,
    তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল,
    তুমি রহো নিরুত্তর—নির্বেদী—নিশ্চল
    মৌন—অন্যমনা;
    প্রিয়ার বক্ষের ’পরে বসি’ একা নীরবে করিছো তুমি শবের সাধনা—

    হে প্রেমিক—স্বতন্ত্র স্বরাট।
    কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট
    উঠিবে জাগিয়া,
    সস্মিত নয়ন তুলি’ কবে তব প্রিয়া
    আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদকৃষ্ণ পাণ্ডু চূর্ণ ব্যথিত কপোলে,
    মিশরঅলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্ব’লে,
    ব’সে আছে অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই;
    ওলটি-পালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই
    জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি–প্রেমের প্রহরা।
    মোদের জীবনে যবে জাগে পাতাঝরা
    হেমন্তের বিদায়-কুহেলি—
    অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি
    গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
    দু-দিনের তরে শুধু; নবোৎফুল্লা মাধবীর গান
    মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
    নিমেষে চকিতে;
    অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
    ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে।

    জীবনানন্দ দাশ
    জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা

  • নীলিমা

    রৌদ্র-ঝিলমিল
    উষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল,
    অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে-বারে
    নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে।
    উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
    উগ্র চুল্লীবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি’,
    আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
    মরীচিকা-ঢাকা।
    অগণন যাত্রিকের প্রাণ
    খুঁজে মরে অনিবার, পায়নাকো পথের সন্ধান;
    চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল;
    হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল
    তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছো মায়াবী!
    জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
    কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
    বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী;
    স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
    মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
    চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধিরলিপিকা,
    জ্ব’লে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
    বসুধার অশ্রুপাংশু আতপ্ত সৈকত,
    ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
    লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
    এই ধূলি—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
    ডুবে যায় নীলিমায়—স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
    শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে নক্ষত্রের রাতে;
    ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক
    তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!

    জীবনানন্দ দাশ
    জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা

  • বঙ্গভাষা (চতুদ্দশপদী কবিতাবলী -মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

    হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
    তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
    পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ পরদেশ,
    ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
    কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
    অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
    মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;
    কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন !
    স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে—
    “ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,
    এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
    যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
    পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
    মাতৃ-ভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে ৷৷ —

  • স্মৃতির ভোরে

    সে আসবে না আর ফিরে
    রেখে গিয়েছে সে আমায়,
    লাল আভা সকালের ভোরে।

    নিশি’র কথাগুলো এখনো জমে থাকে
    আবেগ ও অভিমানে, স্মৃতির ভোরে।

    এখন রাত কেটে যায় চিরকুটের যন্ত্রণাতে
    পরে থাকে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাওয়া
    ক্ষত দেহ আবেগহীন বজ্রপাতে।

    স্মৃতি গুলো আজ মলিনের ভাঁজে
    সে আর ফিরবে না জেনে,
    থেমে রয়েছে যায় উৎযাপন ।

    জানি সে আসবে না
    তাইতো ভোর সকালে সাজে
    মেঘের আলিঙ্গন।

    ~মোস্তাক আহমেদ সাগর

  • কষ্ট নেবে কষ্ট হরেক রকম কষ্ট আছে

    কষ্ট নেবে কষ্ট
    হরেক রকম কষ্ট আছে
    কষ্ট নেবে কষ্ট !
    লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
    পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
    আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
    ‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
    কষ্ট নেবে কষ্ট ।
    ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
    দাড়ির কষ্ট
    চোখের বুকের নখের কষ্ট,
    একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
    কষ্ট নেবে কষ্ট ।
    প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
    অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
    ভুল রমণী ভালোবাসার
    ভুল নেতাদের জনসভার
    হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
    কষ্ট নেবে কষ্ট ।
    দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
    পথের এবং পায়ের কষ্ট
    অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
    কষ্ট নেবে কষ্ট ।
    আর কে দেবে আমি ছাড়া
    আসল শোভন কষ্ট,
    কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
    আমার মত ক’জনের আর
    সব হয়েছে নষ্ট,
    আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।

    হেলাল হাফিজ

    kosto nebe kosto bangla kobita

  • বুঝিনি এতটুকু তোমাকে হারিয়েছিলাম স্বপ্নের ঘোরে

    বুঝিনি এতটুকু তোমাকে
    হারিয়েছিলাম স্বপ্নের ঘোরে
    কতটা পথ ঘুরে এসেছি
    তুমি বন্ধু আমার ছিলে পাশে
    মেঘের পরে আলোর ভীড়ে
    তুমি প্রথম চেয়েছিলে
    বুঝিনি আমি তোমাকে দেখে
    রেখেছ যে কত মায়া-প্রেম
    বুঝতে দাও নি কোন আমাকে
    সাজিয়েছ যা হৃদয়ে
    ছাঁয়া হয়ে ছিলে পাশে
    বল কি করে যাব তোমায় রেখে
    ———–তাহসান

    bujhini etotuku tomake lyrics

  • মাগো ওরা বলে – আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

    “কুমড়ো ফুলে-ফুলে,
    নুয়ে প’ড়েছে লতাটা,
    সজনে ডাঁটায়
    ভরে গেছে গাছটা,
    আর আমি
    ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
    খোকা তুই কবে আসবি ?
    কবে ছুটি?”

    চিঠিটা তার পকেটে ছিল
    ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

    “মাগো, ওরা বলে
    সবার কথা কেড়ে নেবে।
    তোমার কোলে শুয়ে
    গল্প শুনতে দেবে না।
    বলো, মা,
    তাই কি হয়?
    তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।
    তোমার জন্য
    কথার ঝুরি নিয়ে
    তবেই না বাড়ি ফিরবো।

    ল‍হ্মী মা,
    রাগ ক’রো না,
    মাত্রতো আর ক’টা দিন।”
    “পাগল ছেলে,”
    মা পরে আর হাসে,
    “তোর ওপরে রাগ করতে পারি!”
    নারকেলের চিড়ে কোটে,
    উরকি ধানের মুড়কি ভাজে,
    এটা-সেটা
    আরও কত কী!
    তার খোকা যে বাড়ি ফিরবে
    ক্লান্ত খোকা।

    কুমড়ো ফুল
    শুকিয়ে গেছে,
    ঝরে পরেছে ডাঁটা,
    পুঁই লতাটা নেতানো।
    “খোকা এলি?”
    ঝাপসা চোখে মা তাকায়
    উঠানে-উঠানে
    যেখানে খোকার শব
    শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে।

    এখন
    মা’র চোখে চৈত্রের রোদ
    পুরিয়ে দেয় শকুনীদের।
    তারপর
    দাওয়ায় ব’সে
    মা আবার ধান ভানে,
    বিন্নি ধানের খই ভাজে,
    খোকা তার
    কখন আসে কখন আসে।

    এখন
    মার চোখে শিশির-ভোর
    স্নেহের রোদে ভিটে ভ’রেছে।

    বাংলা কবিতা

  • মেঘনা

    বহুদিন ধরে
    আমার ডাইরির পাতা গুলো খালি।
    তাতে আর কিছু লেখা হয় না এখন,
    তার মানে কি জীবন থেমে গেছে?
    হয়তো গেছে, হয়তো বা নয়।
    অথবা এই প্রনয়ের এই শেষ পরিণতি।
    শেষ থেকে শুরু ছিল সেটা
    গল্পটা অথবা একটা দীর্ঘ কবিতা,
    সেটা আমারই লেখা ছিল।
    শেষ থেকে শুরু ছিল এর।
    যেন শেষ পাতা থেকে
    এক একটা শব্দ মুছতে মুছতে
    পিছনে এগিয়ে চলা।
    যেন একটু একটু ভালো লাগা থেকে
    প্রচন্ড নির্ভারতা আর হাঠাৎ করে
    আবিষ্কার করা, গল্পের শেষ এই খানেই।

    যদি কিছু না কিছু লিখে আবার ভরতে চাই
    সাদা পাতা গুলো, নতুন করে?
    যেই শব্দ গুলো লুকিয়ে আছে তার অন্তরে
    দিবে কি ধার আমাকে, আবার নতুন করে?

    Writer: Meghna

  • শিহরণ

    সপ্নপূরণে মন্ত্রের খুঁজে আগামীর পথ ধরি
    বাস্তববতার সবই যেন কঠিন কোনো কাল সাজি
    শূন্যতার মেঘ বাদল ছাড়াই গড়িয়ে পরে
    বৃষ্টি কখন যেন বন্যার রূপ তুলে।
    বেঁচে থাকার সুযোগে অনেক ইচ্ছে হাতছাড়া
    নতুন সিলেবাসে নতুনভাবে হয় নিজেকে গড়া,
    এই যেন মাটি ছাড়াই হাওয়া ভেসে বেড়ানো,
    কোনো কথাই গায়ে আঘাতের চিহ্ন বসায় না
    শক্ত শরীরের মোমের মায়া খাটে না।
    আরতি তে শঙ্খের ডাক কাছে টানে না
    আযানের ধ্বনি রোমাঞ্চকরতার সঞ্চার করে না
    কেমন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে ভিতর
    সংযোগে সংযুক্ত থাকতে চায় না।
    না জানা এই বেনিয়মেয় খেলা,
    তবুও একে লিখতে হয় অংশীদারিত্বের দলিলে
    আমার প্রতিদিনের দিনপঞ্জিকার কোনো এক আড়ালে।
    ভাবি,এই তো সূচনা
    এতেই থেমে গেলে কেমন হবে মহৎ কোনো রচনা!
    সীমিতকরণের ঊর্ধ্বে আমি
    সামান্য এই পীড়নে হয় না এখন ভেঙে পড়া।
    সময় গেলে সাধন হবে না
    সবার মন রাখতে গেলে বাঁচতে হবে না
    তাই নিজের ভাবনাকে মহৎ করি
    একাই মনের নতুনত্ব খুঁজে ফিরি।
    ….
    কলমেঃশাহনাজ রহমান প্রমি

  • ক্লেশ

    মুঠোফোন হাতে যখন সময়ের অবমাননা ব্যস্ত আমি
    হঠাৎ চোখে পরে সেই মুহূর্তগুলো যা কোনো সময় হতো ছিলো অনেক দামি,
    মুছে গিয়েছিল কোনো শক্ত কাঠের রাবারে,
    পেন্সিলে নয়,সুরমায় চোখে সাজিয়ে রেখেছিলাম যাহারে।
    আজ স্বপ্নেও যা ছিন্ন করে,আঘাত হানে দুয়ারে।
    তীব্র রোদের আমেজে
    সূর্যটা অনেক বিরক্তিকর লাগে
    সাতার না জানা নাবিকের সমুদ্র কি ভালোলাগে??
    তেমনি সৃতিচারণও আমার মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ লিখে রাখে।
    মুমূর্ষু হয়ে থাকা শরীরে,কাপুরুষের ছোঁয়া লাগে
    ছিটকে সরিয়ে ফেলে,
    যেন সীতা তার রাম হতে দূরে যায় সরে!
    যেন মধুর বাঁশি সুর রাধাকেও ঘর বন্দি করে!
    চাপা পড়ে যায়,চিৎকার থেমে যায়
    শতকে শতকে তবুও মানুষ তাদেরই জয়গান গায়
    কেউ জেনে প্রেমে পড়ে,কেউ জেনেই দূর সরে।
    তাদের কাহিনী কি আর ইতিহাসের পাতা গায়ে তুলে??
    যদি মরিতে না পারো তুমি ভালোবেসে,
    যদি নাইবা পারো সাদা কোনো প্রাসাদ গড়তে,,
    দিনে দিনে ভাঙা মন মূলহীন হয়ে পড়ে।
    কেন???
    হয়তো তারাই করেছিলো প্রেম,বেসেছিলো ভালো
    আর তোমরা তো শুধু ভেসে গিয়েছিলে আবেগে।
    হাস্যরসিকতার এই খেলা
    অমূল্য কতো অনুভুতিকেই হার মানায়
    কেউ ডায়েরির পাতায় সাজায়,
    কেউ ময়ুরের বেশে রঙে বেরঙের মূর্তি বানায়।
    এমন এক তিক্ত অনুভুতি আমার মনে
    আমায় রক্তমোক্ষণ করে রাখে।
    ….
    কলমেঃশাহনাজ রহমান প্রমি

  • অল্প কাল্পনিকতা

    রাতের আধারে হাজারো তারার মেলা
    সাদা রঙের আভা ছড়িয়ে পরীদলের ছুটে চলা
    বইয়ের কোণে কোণে নিজের নাম সাজিয়ে
    চিত্রকলায় এক আজব দুনিয়া রটিয়ে নেওয়া।
    সময়কে নিজের সঙ্গী করে
    পহরির বেশে অমূল্যতার পাহারা দেওয়া,
    এক নিমিষেই আজানার পথে যাওয়ার ইচ্ছে
    কখনো বা চাদের সাথে চোখাচোখি
    আমাকে দেখে তার মুখে এই ফুটলো বিরাট এক হাসি!
    বাবার হাত ধরে সাত দেশের ভ্রমণ
    মায়ের আচলে নিজেকে লুকিয়ে রাখি
    বোনটাকে নারাজ আঁখিতেই রাখি
    ভাইগুলা তো বড্ড বাজে
    আমি একাই রাজা হয়ে বাঁচি…
    বৃত্তাকার এই গোলকে এমন কতোই না করি কারসাজি।
    দ্রুত ধাবমান জীবনদশায় কতো কিছুই না পিছু ফেলে আসি।
    বয়স বাড়ে, সময়ের চাকা ঘুরে
    শৈশব পেরিয়ে কখন যেন দায়িত্বে পা রাখি,
    নিজ জগতখানা সৃজনশীলতায় দেখি
    বিন্দু সমান আমরা না কো
    তবুও নিজেরে বিরাট করে রাখি।
    কেউবা আবার তুচ্ছ হয়েই ওপারে পা রাখে।
    কিন্তু এমন করি কয়জন?
    ভালো তো সকলেই আমরা, খারাপই বা কয়জন
    বিবেকবান আচরনে পশুচারণ করি।
    না,আমরা সভ্য জাতি,
    তাই অনুকরণ বাকীদের
    অনুশোচনা আমাদের!
    অনুতাপ যেন সঙ্গী মোদের!
    জীবনটা কি এমনি ভেবে রাখি??
    ছুটে চলার প্রতিযোগীতায় আনন্দটা কতই বা আপন করি?
    থামা যাবে না,তবুও ঐ শিশু মনে ফেরার সময় কি হয় না?
    মায়ের আচলে কি আর মুখ লুকানো যায় না?
    বাবার হাতে হাত রাখা যায় না?
    এক অনিবার্য সত্যে খুজে বেরিয়ে পড়ি
    গড়তে হবে,আকাশ ছুতে হবে..
    তবে এই ছোঁয়ার পথে নিজ মনটাকে কবেই যেন মেরে চলে আসি।
    আমি বলি,রাখো এইসব একটু
    তাকাও আবার আকাশ পানে
    যেন আবার চাদের মুখে বিরাট হাসি ফুটে
    এবার সময়টাকে থামিয়ে দাও
    নিজের সময় দেওয়ার একটু সময় করেই নাও!!

    কলমেঃশাহনাজ রহমান প্রমি

  • অগ্রসরতা

    ভালোবাসা বাড়াতে যেখানে দুই মন এক হয়ে
    চার পায়ে, দুহাতে হাত রেখে
    বালির গভীরে ঢেউয়ের সাগরে পাড়ি জমায়
    আমি সেই ভালোবাসার ভয়ে
    সেই নামে রুখে দাড়াই,
    যাকে সময়ে সময়ে হৃদয় গভীরে দিয়েছি ঠাঁই
    আমার চিকন চোখে যারে কালো কাজলে সাজাই
    আজ তার আবেশে নিজেরে দূরে সরাই,
    ক্ষুদ্র জীবনে কারণে অকারণে খুঁজেছি যারে
    হাতের রেখায় নাম খুঁজেছি যার বারে বারে
    তার অনুভুতি আজ আমায় তিলে তিলে ভঙ্গ করে।
    আমি ভাবি বসে কেন এমন
    যা চিরতরে মোরে বিনাশ করে?
    কেন এমন ভোগান্তি, এতো জালাতন?
    উত্তরে আসে তারে রেখে ভাঙা মনে,বাকি জীবন শেষ করে দিবি চিরতরে?
    নাহ!
    বাঁচতে তো হবে,জীবন কি আর পাবো ফিরে
    পিছুটান ছেড়ে নিজের আবার তৈরি করে
    এবার কারো জন্যে নয়,নিজের জন্য বাঁচতে হবে।
    জানি জানি,
    এক দল মানুষ বলিবে,
    তাহলে তো ভালোবাসই নি তুমি তারে,
    আমার বিবেক তাদের মূর্খ বলে সম্মোধন করে।
    ভালোবাসি না বাসি জবাব কি তোমাদের দিতে হবে
    আমার বাকি জীবন বুঝি তুমি ঝাপন করে দেবে??
    হাসির কারণ আগলে রেখে,মিথ্যে আবেগ দেখাবো কেমন করে??
    আমি বলি, ভালোবাসে না থেমে
    নিজের নাও গো তুমি মুখ্য করে,এই তো শুরু
    সফলতা তোমার অপেক্ষায় আছে।
    তারে রাখো মনে,পথের বিপত্তি হইতে দিয়ো নারে।
    অনুভুতি খানা রাখো যতন করে
    এক মাঘে শীত কখনই বা কাটে।
    এখানে না হয় তুমি হেরেই গেলে
    আস্থা রাখো,দুয়ারে না বসে
    দেখোই না এবার জগৎ ঘুরে
    মজবুত হয়ে এবার আবেগ নিম্ন করে
    নিজ আনন্দ খুঁজে নাও মহৎপ্রাণ এই সংসারে।
    ….
    কলমেঃ শাহনাজ রহমান

  • কেমন করে আমরা হবো সেরা মাখলুকা

    কেমন করে আমরা হবো সেরা মাখলুকা

    রাত পোহালে দিনের আলো
    সূর্য ডুবলেই আধার,
    সারাদিন কাজ করেও
    মেলে না তাদের আহার।
    তাদের জন্য পায় না কষ্ট
    পায় না দুঃখ কেউ,
    রোগে সুঃখে তাদের পাশে
    থাকে না তো কেউ।
    আমরাও তো হতে পারতাম
    তাদেরই একজন,
    মহান রবের অশেষ দয়ায়
    আমাদের আছে আপন জন।
    তাদের পাশে যদি না দাঁড়াই
    বাড়িয়ে না দেই হাত,
    কেমন করে হবো আমরা
    সেরা মাখলুকাত।

    মোস্তাক আহম্মেদ সাগর

  • ভয়ের চাদর

    ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি
    সেকেন্ডে সেকেন্ড বছর পেরিয়ে গেলো
    সপ্তাহের বার গুনতে গুনতে
    ক্যালেন্ডার ছাড়িয়ে গেলো
    সেই সময় শেষে বর্তমান আমায় নতুন করে সাজালো।
    কিছুটা পিছু ফিরি
    কবি হওয়ার গল্প বলি?
    মন বাক্সে জমানো আছে,কিছুটা মরিচা গায়ে মেখেছে।
    একটু নেড়েচেড়ে বসি,
    সে বয়সে আবেগের জোয়ার তুলে মনে
    ডায়েরির পাতা যেন এখনো পিছু টানে
    আমি তাকিয়ে বিকেলের আকাশে
    তারে নিয়ে লিখি বসে বসে
    কখনো বা টিপটিপ শব্দে সে কালো মুঠোফোনে।
    ভাবিনি তা জড়িয়ে যাবে,শখ কখনো অস্থির মনের বাঁধন কাটিয়ে দেবে।
    সবটুকুই যে মমতায় জড়ানো কোনো এক রূপকথা
    শুরুটা অবাক হলেও,শেষটা মনগড়া।
    আমার শুরুটা এমনি
    মুসাফিরের বেশে মমতাজ আমি
    অনুভুতি গুলো যে অনেক দামী।
    বলে দেবো?
    কালো কালিতে সাজিয়ে
    তারে দর বাজারে নামিয়ে দেবো?
    না গো না!
    ইহা যেন বিন্দু বিন্দু রটিয়েছি আমি।
    এই বিরাট মহলে বিতর্ক অনেক
    লোকলজ্জার লাজ অনেক
    সম্মানের ভয় অনেক
    যদি আমার গল্প নিয়ে এরা বাজি ধরে,
    হাসাহাসি করে!
    আমি এতো মূল্যহীন,তাহা করি কী করে?
    তাই আমিও থাকি তালাবদ্ধ হয়ে
    যখনি পাড়ি জমাই ভিড়ের সংসারে
    বুঝে নিও,যদি তোমারও জানতে ইচ্ছে করে
    সহানুভূতি চাই না গো
    ইহা আজকাল মিথ্যা দামে,সবার কাছেই মিলে।

    কলমেঃ Sahnaj Rahman