Category: Book | বই

  • হাদীসের নামে জালিয়াতি প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা by ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

    আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুরফুরার পীর আমীরুল ইত্তিহাদ মাওলানা আবুল আনসার মুহাম্মাদ আব্দুল কাহহার সিদ্দীকী আল-কুরাইশী সাহেবের
    বাণী
    নাহ্মাদুহু ওয়া নুসাল্লী আলা রাসূলিহীল কারীম, আম্মাবা’দ কুরআন কারীমের পরে দীন ইসলামের মূলভিত্তি হলো হাদীস। এজন্য হাদীস বিশুদ্ধভাবে শিক্ষা করতে, মুখস্থ রাখতে ও প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ ﷺ। একই সাথে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন তাঁর নামে মিথ্যা- বলতে। মিথ্যা হতে পারে এরূপ সন্দেহজনক কোনো কথা তাঁর নামে যে বলবে, সেও মিথ্যাবাদী বলে গণ্য হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

    হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রচেষ্টা সেই প্রাচীন যুগ থেকেই অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে সাহাবীগণের যুগ থেকেই মুসলিমগণ হাদীসের নামে সকল প্রকার মিথ্যা ও জালিয়াতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ সকল জাল হাদীস চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ক সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেক আলিম বা নেককার মানুষও না জেনে অনেক জাল হাদীস রলেন, প্রচার করেন বা লিখেন। এভাবে সমাজে অনেক জাল হাদীস ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা অনেকেই গাফলতির কারণে এ কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত হচ্ছি।
    জাল হাদীসের উপর আমল করেও আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল )ﷺ( যা করতে বলেন নি তা করে আমরা পণ্ডশ্রম করছি। উপরন্ত আমরা সহীহ হাদীসের উপর আমল করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি। এজন্য মুসলিম উম্মাহর আলিমগণের উপর অর্পিত একটি ফরয দায়িত্ব হলো সমাজে প্রচলিত জাল হাদীসগুলো চিহ্নিত করা এবং এগুলোর খপ্পর থেকে সমাজকে রক্ষা করা। রাসূলুল্লাহ )ﷺ(-এর সুন্নাতকে জীবিত করার এ হলো অন্যতম পদক্ষেপ। আমার স্নেহাস্পদ জামাতা খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে আমি গত কয়েক বছর যাবৎ এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনার জন্য নির্দেশ ও উৎসাহ প্রদান করছি। আল্লাহ পাকের রহমতে এতদিনে সে এ বিষয়ে একটি বই প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।

    আমি আমার মুহিব্বীন, মুরীদীন ও দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলমিকে বইটি পাঠ করতে অনুরোধ করছি। যে সকল কথাকে ‘জাল হাদীস’ বলে জানতে পারবেন সেগুলোকে কোনো অজুহাতেই আর বলবেন না বা পালন করবেন না। তাহকীক করুন। কিন্তু ‘অমুক বলেছেন’, ‘তমুক লিখেছেন’.
    ‘সহীহ না হলে কি তিনি বলতেন বা লিখতেন’ ইত্যাদি কোনো অজুহাতেই সেগুলো বলবেন না বা পালন করবেন না। আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর দরবারে তার নিজের কর্মের হিসাব দিতে হবে, অন্যের কর্মের নয়।

    কেউ হয়ত না জেনে বা ভুলে জাল হাদীস বলেছেন, সে কারণে কি আমি জেনে-শুনে একটি জাল হাদীস বলব? কারো হয়ত অনেক নেক আমল আছে, যেগুলোর কারণে আল্লাহ তার এরূপ দু’-চারটি ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার এ ইচ্ছাকৃত কঠিন পাপের ক্ষমা মিলবে কিভাবে?
    কোনো হাদীস জাল বলে জানার পরে মুমিনের দায়িত্ব হলো তা বলা বা পালন স্থগিত করা। প্রয়োজনে সে বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে নিশ্চিত হতে হবে। কোনো বিষয়ে এ গ্রন্থের লেখকের ভুল হয়েছে বলে মনে হলে আপনারা আরো ‘ইলমী তাহকীক’ বা গবেষণা করবেন এবং মুহাদ্দিসগণের মতামত বিস্ত ারিত জানার চেষ্টা করবেন। ভুল প্রমাণিত হলে তাকে বা আমাকে জানাবেন। তবে গায়ের জোরে বা মুহাদ্দিসগণের সুস্পষ্ট মতামতের বাইরে কিছু বলবেন না। মনে রাখবেন যে, কোনো মুসলিম যদি জীবনে একটিও ‘হাদীস’ না বলেন তবে তার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু ওয়ায, দাওয়াত, ইবাদত বা অন্য যে কোনো নেক উদ্দেশ্যে যদি তিনি একটিও মিথ্যা বা জাল হাদীস বলেন তবে তা হবে কঠিনতম একটি পাপ।

    মুসলিম উম্মাহ একমত যে, জাল হাদীস বলা বা রেওয়ায়াত করাও কঠিনতম হারাম। পোশাক-আশাক, পানাহার ইত্যাদির ক্ষেত্রে হারাম হালাল বিষয়ে যেমন সতর্ক থাকতে হয়, কথাবার্তার ক্ষেত্রেও তেমনি হারাম-হালাল বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ )ﷺ( যা বলেন নি, তা তাঁর নামে বলা হলো সবচেয়ে কঠিন হারাম কথা। এ বিষয়ে সতর্কতা অতীব জরুরী।
    মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন এ গ্রন্থখানা কবুল করেন এবং লেখককে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করেন। বইটি প্রকাশে যারা সহায়তা করেছেন এবং যারা গ্রন্থটি পড়বেন বা প্রচার করবেন তাদের সকলকে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি, বরকত, কল্যাণ ও উন্নতি দান করুন। আমীন!
    আত্কারুল ইবাদ,
    আবুল আনসার সিদ্দীকী (পীর সাহেব, ফুরফুরা)

  • বিশ্বাসের যৌক্তিকতা by রাফান আহমেদ

    ভূমিকা
    আল্হামদুলিল্লাহ। রাফান আহমেদ ভাইয়ের বিশ্বাসের যৌক্তিকতা (Reasons To Believe) বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। আমি আদতে কুরআনের ভাষায় ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’ দলের সদস্য হবার চেষ্টায় থাকলেও, ব্যক্তিগতভাবে যুক্তি-তর্ক আমার খুব পছন্দের। স্রষ্টা আসলে বিজ্ঞানের আলোচ্য টপিকের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু আমরা যদি বিজ্ঞানকে স্রষ্টার সৃষ্টির একটা অংশ ধরে নিই, তাহলে বিজ্ঞানের কোন কিছুই স্রষ্টার বিপরীতে যেতে পারে না। স্রষ্টা বিজ্ঞানের বিষয় না হলেও, বিজ্ঞানের sign এর মাঝে স্রষ্টাকে তখন অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যাবে।
    বস্তুবাদী দুনিয়ার খপ্পরে পড়ে বর্তমান বিজ্ঞান বড্ড একপেশে হয়ে গেছে।
    স্রষ্টার সাথে বস্তুবাদী দুনিয়া যেন এক মহা সংগ্রামে লিপ্ত। কিন্তু, বস্তুবাদী দুনিয়া
    যতোই রঙচঙে ভাবমূর্তি নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াক না কেনো,
    সত্যের সামনে সে বারবার পর্যদুস্ত হতে বাধ্য।

    বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোন স্থান নেই, এটা স্রেফ তথ্য প্রমাণ নির্ভর – এ – কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কিন্তু ধর্মের মূল ভিত্তিই হলো বিশ্বাস। তাছাড়া বিজ্ঞান আজ এটা বলছে তো কাল ওটা। বিজ্ঞানকে আমরা চির-নির্মাণাধীন (endlessly becoming) প্রক্রিয়া বলতে পারি। এখানে কোন কোন থিওরি দুইশো বছর টিকে, আবার কোন কোন থিওরি দুই সেকেন্ডও টিকে না। এই হলো বিজ্ঞানের অবস্থা।
    বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের কোন সংঘাত নেই, সহাবস্থান আছে। কিন্তু বস্তুবাদী দুনিয়া আমাদের চোখে একটি রঙিন চশমা পরিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে যে, ধর্ম এবং বিজ্ঞান পরস্পর সাংঘর্ষিক। রাফান আহমেদের ছোট অথচ ব্যাপক তথ্যবহুল এই বইটিতে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ধর্মবিশ্বাস মানুষের একটি সহজাত বিষয়। এটি সে জন্মগতভাবে পেয়ে থাকে। এটি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।

    তাছাড়া, বস্তুবাদী জগতের অনেক বিজ্ঞানী, দার্শনিকের মন্তব্য, গবেষণালব্ধ তথ্য টেনে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ‘বিজ্ঞান কখনোই শেষ কথা নয়’…
    বইটিতে তথ্যের ব্যাপক সমাহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। রাফান আহমেদের উপস্থাপনা শৈলিও চমৎকার। প্রতিটি অধ্যায়ই ভাবনার উদ্রেক করে। বইটি প্রতিটি পাঠককে উপকৃত করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
    আল্লাহ্ উনার এই কাজকে কবুল করুন, আ-মী-ন।
    আরিফ আজাদ লেখক – প্যারাডক্সিকাল সাজিদ। আরজ আলী সমীপে

    bisshosera-joiktikota Rafan Ahmed

  • ম্যাসেজ আধুনিক মননে দ্বীনের ছোঁয়া by ড. মিজানুর রহমান আজহারি

    লেখকের কথা
    সমস্ত প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্যই নিবেদিত, যাঁর অপার করুণায় সকল ভালো কাজ পূর্ণতা পায়। দরুদ ও সালাম প্রিয়নবি মুহাম্মাদ-এর প্রতি, যিনি সত্যের বাণী সর্বত্র পৌঁছে দিতে আমাদের আহ্বান করেছেন। ২০২১ সালের বইমেলায় ‘ম্যাসেজ : আধুনিক মননে দ্বীনের ছোঁয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত বইটি বাংলা ভাষায় আমার প্রথম কাজ। নিজেকে বাংলা সাহিত্য-দুনিয়ায় যুক্ত করতে পেরে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত।
    আমি ক্ষুদ্র মানুষ। জ্ঞান-দুনিয়ার দুর্বল ছাত্র। প্রতি মুহূর্তে নিত্য-নতুন কিছু জানার চেষ্টা করছি। সত্যের অনুপম ছোঁয়ায় নিজেকে ঋদ্ধ করার অবিরত এক সংগ্রামে আছি। তীর পেরিয়ে জ্ঞান-সমুদ্রের যত গভীরে প্রবেশ করছি, নিজেকে তত দুর্বল, অসহায়, অন্তঃসারশূন্য ও ক্ষুদ্র হিসেবে আবিষ্কার করছি। রবের দুনিয়া কত বড়ো, তাঁর কত নিয়ামতে ডুবে আছি আমরা! পৃথিবীর প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে জ্ঞানের মণি-মুক্তা, রত্ন! কটা ভাঁজেই আর বিচরণ করা যায়!

    নিজের সীমাবদ্ধতা জানা সত্ত্বেও উম্মাহর তরুণদের নিয়ে কেন জানি পেরেশানিতে ভুগি। একুশ শতকের তারুণ্য কী এক মরীচিকার পেছনে ছুটছে! এই প্রজন্মেরই একজন হয়ে খুব করে তাদের মানসপটকে বোঝার চেষ্টা করি। তাদের লাইফস্টাইল, চিন্তাধারা ও কর্মত্তপরতা বেশ বুঝতে পারি। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, কথার টোন, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানকে উপলব্ধি করতে পারি। মূলত, আমার ক্ষুদ্র কর্মতৎপরতা এই তরুণদের ঘিরেই। তাদের জন্য ভাবি, বলি, লিখি, কন্টেন্ট তৈরি করি। কারণ, এই প্রজন্মকে যদি সঠিক পরিবহনে তুলে দেওয়া যায়, তাহলে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছবেই। ভুল গাড়িতে উঠিয়ে হা-হুতাশ করে কী লাভ!
    দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কুরআনের ম্যাসেজ পৌঁছে দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল রাব্বুল আলামিনের দয়ায়। একজন দাঈ হিসেবে সাধারণত কথা বলাটাই আমার স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা। গত সাত বছরের দাওয়াতি অভিযাত্রায় অনেক শ্রোতা আমার লিখিত বইয়ের আবেদন করেছেন। আমি জেনেছি-শোনার পাশাপাশি শ্রোতাদের বড়ো একটা অংশ পড়তে ভালোবাসেন। ইন্টেলেকচুয়াল সার্কেলে বই ও সাহিত্যের একটা আলাদা আবেদন আছে। সাহিত্যাঙ্গনে একজন দাঈ চাইলেই কিছু কন্ট্রিবিউট করতে পারেন।

    দাওয়াহর সাহিত্যিক প্রেজেন্টেশনও বেশ কার্যকর ও টেকসই। লেখনী মানেই স্থায়ী
    রেকর্ড-এই ভাবনা থেকেই লেখালিখির আগ্রহটা তৈরি হয়।
    এই গ্রন্থে একেবারে ঐতিহাসিক ও এক্সক্লুসিভ কোনো তথ্য হয়তো পাবেন না; এ আমার জ্ঞানের ক্ষুদ্রতা। বলতে পারেন, কুরআনের কর্মী হিসেবে সাহিত্য-জগতে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা প্রচেষ্টা এই গ্রন্থ। সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে আমি সুনির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে আলোচনা করেছি, গ্রন্থের প্রতিটি লেখায় সেসব আলোচনার নোটই প্রাথমিক সোর্স। বইটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি, লেখার চেয়ে বলা অনেক সহজ।
    বইটিতে কুরআন-সুন্নাহর উদ্ধৃতি, সাহাবিদের বক্তব্য, সালাফদের কথা, বিভিন্ন শিক্ষণীয় ঘটনা, ক্লাসিক্যাল ও আধুনিক স্কলারদের রেফারেন্সের পাশাপাশি আমার নিজস্ব একান্ত কিছু চিন্তা-ভাবনা উপস্থাপিত হয়েছে। সাহিত্য-দুনিয়ায় বই মানেই যে শব্দের মারপ্যাঁচে ভারী ভারী কথা, এই গ্রন্থকে সেখান থেকে খানিকটা দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। রাশভারী কথামালা পরিহার করে সাধারণ মানুষের ভাষায় লেখাগুলো সাজানোর একটা প্রয়াস এখানে আছে। সকল ধর্ম, বয়স, শ্রেণি-পেশার পাঠক নিজেদের সাথে বইটিকে কানেক্ট করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

    নতুন ধারার প্রতিশ্রুতিশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স’-কে পাশে
    পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ। পুরো গার্ডিয়ান টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। গ্রন্থটিকে পাঠকদের
    সামনে স্মার্টলি উপস্থাপন করতে বেশ কিছু তরুণ দিন-রাত শ্রম দিয়েছে, সংশ্লিষ্ট
    সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। প্রত্যেকের কল্যাণ কামনা করছি।
    মানুষ হিসেবে আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। এই বইটিতে কোনো ভুল থাকবে না-এমন দাবি করার দুঃসাহস করছি না। মানবিক দুর্বলতার কারণে বিশেষ কোনো টাইপিং মিসটেক অথবা তথ্যগত কোনো অসংগতি আপনাদের চোখে পড়লে দয়া করে আমাদের জানাবেন; পরবর্তী সংস্করণে সেটা সংশোধন করে নেব, ইনশাআল্লাহ।
    বাংলাভাষী পাঠকদের নিকট ইসলামের সৌন্দর্য, মূল তাৎপর্য, স্পিরিট ও মধ্যমপন্থার শিক্ষা তুলে ধরতে বইটি কিছুটা হলেও অবদান রাখবে বলে আশা করছি। ‘ম্যাসেজ’ বইটিতে কিছু বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আধুনিক মননে দ্বীনের ছোঁয়া লাগাতে বইটিকে আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন। আমিন।
    মিজানুর রহমান আজহারি ৩০ মার্চ, ২০২১

    message by mizanur rahman azhari pdf

  • প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ by আরিফ আজাদ

    বিশ্বাসের কথা কতটা শক্ত করে বলা যায়? বিশ্বাসী প্রানের সুর কতটা অনুপম হতে পারে? বিশ্বাসকে যুক্তির দাঁড়িপাল্লায় মাপা কি খুব সহজ? অবিশ্বাসীকে কতটা মায়াভরা স্পর্শে বিশ্বাসের শীতল পরশ দেয়া যায়? যুক্তিই মুক্তি নাকি বিশ্বাসের যুক্তিতে মুক্তি?
    ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ এসবের উত্তর মিলতে পারে। পড়ে

    প্রকাশকের কথা

    সভ্যতার শুরু থেকেই সত্য ও মিথ্যার ধারাবাহিক লড়াই। মানবতার সমাধান ইসলাম বরাবরই জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকদের অপপ্রচার ও বিদ্বেষ মোকাবেলা করে আসছে। আধুনিক সভ্যতার এই সময়ে দাঁড়িয়েও সেই ধারা অব্যাহত আছে। স্যোসাল মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান পরিসরকে ব্যবহার করে ইসলামদ্রোহী শক্তি সুকৌশলে তরুন প্রজন্মের চিন্তার রাজ্যে সন্দেহের বীজ বোপন করছে। সন্দেহ থেকে সংশয়, সংশয় থেকে অবিশ্বাস। এভাবে এক অবিশ্বাসী প্রজন্মের গোঁড়াপত্তন হচ্ছে কিবোর্ডে। কিছু অযাচিত বুলি শিখে, প্রশ্নের ডালি নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বাসীদের সুশৃংখল চিন্তার দুনিয়ায়। কিছু কিছু তরুন-যুবা দিকভ্রান্তও হচ্ছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতে। অবিশ্বাসীদের আপাত চমকপ্রদ প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় হিমশিম অবস্থা। জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ যেখানে, সেখানেই বিশ্বাসী প্রাণের যৌক্তিক লড়াই। এমনই এক বিশ্বাসী তরুন আরিফ আজাদ। অনলাইন দুনিয়ায় অবিশ্বাসীদের উত্থিত প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিয়ে অজস্র মানুষের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। একজন তরুন এত চমৎকার ও যৌক্তিক ভাষায় ইসলামবিরোধীদের জবাব দিতে পারেন, ভাবতেই আশাবাদী মন জানান দেয়- আগামীর দিন শুধু সম্ভাবনার। ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’ বইটিতে গল্প ও সাহিত্যরস দিয়ে অবিশ্বাসীদের নানান প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে।

  • এবার ভিন্ন কিছু হোক (বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের দ্বিতীয় কিস্তি) -আরিফ আজাদ

    এবার ভিন্ন কিছু হোক (বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের দ্বিতীয় কিস্তি) (পেপারব্যাক)
    জীবনের জাগরণ সিরিজ ২

    by আরিফ আজাদ

    কালের ঘূর্ণাবর্তে সবকিছুর পালাবদল ঘটছে। পরিবর্তন আসছে জীবনের রূপ ও রঙে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন চিন্তা এসে গ্রাস করছে পুরোনো চিন্তার জগৎ। এভাবেই চলছে গ্রহণ-বর্জনের নিরন্তর চক্র।
    কালের এই চক্রে সবকিছুতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও একমাত্র ইসলাম-ই চৌদ্দশত বছর ধরে চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান বিকাশের অবিকৃত ও পরিপূর্ণ ধারায় রয়েছে বিরাজমান৷ মানবজাতির জন্য নির্দেশিকা হিসেবে নাযিল হওয়া ইসলামের বার্তাসমূহের রয়েছে সমসাময়িক ও আগামী জীবনের উপযোগিতা৷ ইসলামের সুমহান সেই বার্তাগুলো-ই বিশ্বাসী মানুষের দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘সমকালীন প্রকাশন’-এর পথচলা।

    লেখকের কথা
    ‘জীবনের জাগরণে’ সিরিজের প্রথম বই ছিলো বেলা ফুরাবার আগে। বইটা আমার কতো যে প্রিয় আর বইটাকে ঘিরে গত দুবছরে কতো কতো ঘটনার যে জন্ম হয়েছে, তা বলে শেষ করার মতো না। কীভাবে শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এই অপার নিয়ামতের হক আদায় হবে, তা আমার জানা নেই; কিন্তু তাঁর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে শেষ করতে পারা আদৌ কি সম্ভব? আলহামদুলিল্লাহ।
    বেলা ফুরাবার আগে বইটা যখন লিখি, তখন আমার ধ্যান-জ্ঞান সব যেন বইটাকে ঘিরেই। আমি স্বপ্ন দেখতাম—আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইচ্ছাতে এই বই যুবক-যুবতীদের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। তারা সালাতের প্রতি উদগ্রীব হচ্ছে, হারাম রিলেশান ছেড়ে দিচ্ছে, ফোন মেমোরি থেকে ডিলেট করে দিচ্ছে সমস্ত গান, যা না শুনলে রাতে তাদের ঘুম হতো না। ফোনের গ্যালারি থেকে তারা মুছে

    দিচ্ছে সেসকল ছবি আর ভিডিও, যা তাদের কু-প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করতো একদা। তারা বিনয়ী হচ্ছে, সময়ের গুরুত্ব বুঝছে, তারা সুন্নাহ আর নফল পালনের দিকে ঝুঁকছে, ফজর আর তাদের কাযা হচ্ছে না—বইটা লিখবার প্রাক্কালে এসবই ভাবতাম আর আল্লাহর কাছে অনেক দুআ করতাম। আল্লাহকে বলতাম, তিনি যেন আমার স্বপ্নগুলোকে সত্যি করেন আর বইটাকে কবুল করেন।
    আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর বারাকাহ আর প্রকাশ্য সাহায্য যে কী জিনিস, তা আমি বরাবরের ন্যায় আবারও উপলব্ধি করলাম। বেলা ফুরাবার আগে বইটাকে নিয়ে আমি যে যে স্বপ্ন একদা মনে মনে আঁকতাম, হাঁটতে হাঁটতে যে দৃশ্যগুলো দোলা

    দিয়ে যেতো আমার হৃদয়ে, সেসবকিছুই আমার রব বাস্তবে পরিণত করেছেন। গোটা বাংলাদেশ তো বটেই, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশের মাঝে বইটাকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস, যে আগ্রহ আমি দেখেছি, সোশ্যাল মিডিয়া, মেইল ও ইনবক্সে বইটা পড়ার পর যে সমস্ত পরিবর্তনের কথা আমি শুনেছি মানুষের কাছ থেকে, তা দেখে আমি বিশ্বাস করি যে, আমার মহান রব আমার দুআগুলো কবুল করেছেন। তিনি বইটাকে যুবক-যুবতীসহ অনেক অনেক মানুষের পরিবর্তনের অসিলা হিশেবে গ্রহণ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
    বইটা প্রকাশের দুবছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ বইটা পড়ে তাদের পরিবর্তনের কথা জানাচ্ছেন। এ যে কী মধুর ভালো লাগা, তা বর্ণনার জন্য যথাযথ শব্দ দুনিয়ার কোনো ভাষাতে মজুত নেই। আলহামদুলিল্লাহ!

    বেলা ফুরাবার আগে বইটাকে আমি বলেছিলাম ‘সাজিদ’ তৈরির মিশন। প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ পড়ে যারা সাজিদ হতে চাইবে, তারা যখন জানতে চাইবে সাজিদ হতে হলে তাদের কী কী করতে হবে, আমি বলেছিলাম তারা যেন বেলা ফুরাবার আগে বইটাতে চোখ বুলায়। আমি ভীষণভাবে বিশ্বাস করি—আত্মিকভাবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা না গেলে কখনোই পরম পবিত্রতার সন্ধান লাভ সম্ভব নয়। আত্মার সেই শুদ্ধতার দিকে যুবক-যুবতীদের ধাবমান করতেই আমি বইটার কাজে হাত দিয়েছিলাম। যেহেতু যুবক বয়সের সমস্যাগুলোর ভেতর দিয়ে আমি নিজেও যেতাম এবং এখনো যাই, তাই সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা আমার জন্য কঠিন কিছু ছিলো না। সেই সমস্যাগুলোর পরতে পরতে আমি হাঁটতে চেষ্টা করেছি এবং বের করে আনতে চেয়েছি সেসবের সম্ভাব্য সবচেয়ে সঠিক চিকিৎসাটাই।

    অনেক পাঠক আমাকে বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের দ্বিতীয় কিস্তি আনার অনুরোধ করেছেন। যুবক বয়সের যেহেতু সমস্যার অন্ত নেই এবং তা ক্রমবর্ধমান, তাই আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো এই ধরণের আরো বই নিয়ে কাজ করার। আলহামদুলিল্লাহ, মহান রব আমার সেই বাসনাটাও পূরণ করেছেন। এবার ভিন্ন কিছু হোক নামে এই সিরিজের পরের বইটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রকাশের সুযোগ দিলেন আমাকে। আমার রবের দরবারে অফুরান কৃতজ্ঞতা।
    এবার ভিন্ন কিছু হোক বইটা বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের পরের কিস্তি। দুটো ব‍ই প্রায় একই ধাঁচে লেখা। আমি চেষ্টা করেছি অধ্যায়গুলোকে জীবনঘনিষ্ঠ রাখতে,

    যাতে পাঠকেরা পড়ার সময় নিজের অবস্থাকে কল্পনা করতে পারেন। যিনি বইটা হাতে নিয়ে পড়বেন, তার যেন মনে হয় বইটা আমি তার জন্যই লিখেছি এবং বইয়ের কথাগুলো যেন আমি তার পাশে বসে বসে তাকে শোনাচ্ছি। পাঠকের মনোযোগ যাতে বিচ্ছিন্ন না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছি আমি, আলহামদুলিল্লাহ।
    এই বইতেও পাঠকেরা অনেকগুলো সমস্যার সমাধান পাবেন এবং আরো পাবেন অনেক আশার আলোও। যেহেতু আমি খুবই আশাবাদী একজন মানুষ, তাই মানুষকে আশা নিয়ে বাঁচতে স্বপ্ন দেখাতেই আমি ভালোবাসি। আর কেনই-বা নিশারাবাদী হবো? অবিশ্বাসীরা ছাড়া আর কারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়?
    বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের মতো এই বই নিয়েও আমার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা—তিনি এই বইটাকে যেন কবুল করেন আর আমার নাজাতের অসিলা বানিয়ে দেন। তিনি যেন আমাকে সর্বদা মাটির মানুষ থাকার সুযোগ দেন। সমস্ত অহংকার, রিয়া আর বড়োতু থেকে তিনি যেন আমাকে মুক্ত রাখেন।

    অসিলা বানিয়ে দেন। তিনি যেন আমাকে সর্বদা মাটির মানুষ থাকার সুযোগ দেন।
    সমস্ত অহংকার, রিয়া আর বড়োত্ব থেকে তিনি যেন আমাকে মুক্ত রাখেন।
    বরাবরের মতোই আমার পাঠকদের কাছে অনুরোধ—পড়া শেষ হলে বইটা নিজের কাছে রেখে দেবেন না। আপনার নিকটাত্মীয়, বন্ধু, ভাই-বোন বা এমন কারো কাছে বইটা হস্তান্তর করবেন, যার জন্য বইটাকে আপনি দরকারি মনে করবেন। সকল পাঠকের জন্য আমার অফুরান ভালোবাসা। ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা এই বইটার পেছনে যারা বিভিন্নভাবে শ্রম দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা সমকালীন প্রকাশনের প্রতি, বইটাকে পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে যাবতীয় বন্দোবস্তের ভার গ্রহণের জন্যে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন আমাদের সবাইকে জান্নাতের সবুজ উদ্যানে একত্রিত করেন। আমিন।
    ওয়ামা তাওফিক্বী ইল্লা বিল্লাহ।
    আরিফ আজাদ

    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
    এক.
    যাপিত জীবনের গল্প থেকেই বলি—আমরা যখন রোগে-শোকে ভুগি, যখন শরীরে আমরা অনুভব করি কোনো রোগের উপস্থিতি, তখন আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার, যিনি আমাদের সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট থাকেন মাথাভরতি ডাক্তারি-বিদ্যা নিয়ে, তার কাছে আমরা খুলে বলি আমাদের অসুবিধের আদ্যোপান্ত। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন আমাদের অসুস্থতা। প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি দিয়ে আমাদের শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন। রোগ নির্ণয়ের পর আমাদের ওষুধ ও জীবনযাত্রার একটা ছক নির্ধারণ করে দিয়ে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করার কঠোর হুঁশিয়ারিও প্রদান করেন।

    পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে কিংবা আশানুরূপ ফলাফল না এলে আমরা ছুটে যাই শিক্ষকদের কাছে। তাদের কাছে—যারা আমাদের চোখে অধিকতর যোগ্য। কৃতকার্যতার অথবা ভালো ফলাফলের পথ বাতলে দিতে যারা সবিশেষ পারদর্শী, তাদের দুয়ারে ধরনা দিই আমরা। ভালো ফলাফলের রাস্তা বাতলে দিয়ে তারা ধন্য করেন আমাদের। কৃতকার্য হতে হলে যে পথ ধরে এগুতে হবে, যে কঠোর-কঠিন সাধনায় লেগে থাকতে হবে মুখ বুজে—সেই পথ তারা আমাদের চিনিয়ে দেন।
    মাঝে মাঝে জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, যখন ফিকে হয়ে আসে জীবনের সমস্ত রং, তখন আমরা এমন কাউকে খুঁজি, যে আমাদের একটু আশার আলো দেখাবে।

    এমন কাউকে—যার কাছে গেলে আমরা খুঁজে পাবো জীবনের ছন্দ, যার স্পর্শ পেলে হয়তো দপ করে জ্বলে উঠবে নিভুনিভু হওয়া জীবন-প্রদীপ।
    যাপিত জীবনের শূন্যতাগুলোকে উত্তম বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপনের বেলায় আমাদের থাকে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। যখনই কোনো শূন্যতার বলয়ে আমরা ঘুরপাক খাই, আমাদের অবচেতন মন তার নিজের মতো করে সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে। বস্তুত মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই এটা। মানুষ শূন্যস্থান পছন্দ করে না বলেই তা পূরণে সে সবিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে।

    দুই.
    রোগ হলে আমরা ডাক্তারের কাছে ছুটি, পরীক্ষায় ভালো ফল লাভের উপায় জানতে ধরনা দিই যোগ্য শিক্ষকের কাছে। বিষিয়ে ওঠা জীবনের যাতনা থেকে মুক্তি পেতে আমরা পাগলের মতন খুঁজে নিই পছন্দের ব্যক্তি, বস্তু অথবা মাধ্যম, যা-কিছু আঁকড়ে ধরলে আমরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেতে পারি; তবে যদি প্রশ্ন করি— নফসের তাড়না থেকে বাঁচতে কখনো কি আমাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে? যে কুপ্রবৃত্তির বলয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে সেঁটে আছে জীবন, সেই বলয় ভাঙতে কখনো কি হৃদয়ে দানা বেঁধেছে একটুখানি সাহস?
    শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে তাকে আমরা সমস্যা বলছি। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়াকে ডাকছি অপ্রাপ্তি বলে। জীবনের ছন্দপতনের নাম দিয়েছি হতাশা; কিন্তু কুপ্রবৃত্তির যে জালে আমি সারাটাজীবন ধরে আটকা পড়ে আছি, তার জন্য কোনো নাম কিংবা কোনো অভিধা কখনো কি ভেবেছি একবারও?

    যে তাড়না আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে আল্লাহর নৈকট্য থেকে, যে ধোঁকা আমাকে আত্মমগ্ন করে রেখেছে অবাধ্যতায়, যে আত্মপ্রবঞ্চনায় কেটে যাচ্ছে জীবনের সোনালি সময়, সেই ঘনঘোর অন্ধকার থেকে পালাতে কখনো কি আমার মন চেয়েছে?
    কেন আমি বারবার বন্দি হয়ে যাই নফসের শেকলে? কেন কুপ্রবৃত্তির মায়াজাল ভেদ করা আমার জন্য দুরূহ হয়ে ওঠে? কেন বৃত্তের একই কেন্দ্রে আমার নিত্য ভুলের বিচরণ? যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় আমার আগমন, সেই উদ্দেশ্য থেকে কেন আমি ভীষণরকম বিচ্যুত? রুহের জগতে মহামহিম আল্লাহ যখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমিই কি তোমার রব নই?’, তখন আমি মহোৎসাহে, আনন্দে

    আত্মহারা হয়ে, বিস্ময়মাখানো কণ্ঠে বলেছিলাম, ‘অবশ্যই, আপনিই আমার রব। [১] তবে আজ কেন ভুলে গেলাম আমার জীবনের সেই প্রথম আর পরম স্বীকৃতির কথা?
    এই যে কুপ্রবৃত্তির বাঁধনে আমি বন্দি হয়ে আছি, সেই শৃঙ্খল ভাঙার উপায় কী? কোন উপায়ে আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারবো এই চোরাফাঁদ থেকে? কোন পথে নিহিত আমার মুক্তি? কীভাবে আমি জীবনের সেই আসল উদ্দেশ্যের বাঁকে ফিরতে পারবো—এসব নিয়ে যদি একটু ভাববার ফুরসত পাই, আমার জন্য সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। যখনই আমি সমস্যার বৃত্তে ঘুরপাক খাবো, তখন যদি নিবিষ্ট মনে আমি খেয়াল করি আল্লাহর কালাম—এই আয়াতের দিকে, আমি পেয়ে যেতে পারি আমার কাঙ্ক্ষিত সেই সমাধান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন—
    তাদের পরে এলো এমন এক অসৎ জাতি, যারা সালাত বিনষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো ।[২]

    আমি যদি বুদ্ধিমান হই এবং আমার বিবেচনাবোধ আর উপলব্ধি ক্ষমতা যদি একেবারে ফুরিয়ে না গিয়ে থাকে, তাহলে এতক্ষণে আমি বুঝে গেছি, আমার শূন্যতাটা আসলে কোথায়। কোন জায়গায় এসে আমার জীবন থমকে গেছে, কোন কেন্দ্রে এসে আমি আসলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি, কোন ভ্রান্তির মায়াজালে আমি আটকে পড়েছি তা এতক্ষণে আমার চোখে পড়ার কথা ।
    হ্যাঁ, আমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথাই বলছি। এটাই তো মানবজীবনের ছন্দ। এই ছন্দের শূন্যতাই তো জীবনে ছন্দপতন ঘটায়। এটি আমার কথা নয়, স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কথা। তিনি ধ্বংস ও অভিশপ্ত এক জাতির উদাহরণ টেনে বলছেন, ‘এমন এক জাতি এলো, যারা সালাত বিনষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।’ আল্লাহ তো বলতে পারতেন, ‘তারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো এবং সালাত বিনষ্ট করলো।’ কিন্তু তিনি সেভাবে বলেননি। তিনি আগে সালাত বিনষ্টের কথা বলেছেন এবং এরপর বলেছেন কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের কথা।

    [১] সুরা আরাফ, আয়াত : ১৭২
    [২] সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৫৯

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অভিশপ্ত এক জাতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন যে, তারা সালাত বিনষ্ট করেছে এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। তারা কিন্তু আগেই কুপ্রবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়েনি। আগে তারা সালাত ছেড়েছে। সালাত ছেড়ে দেওয়াতে সহজেই তারা কুপ্রবৃত্তির দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং এর ফলস্বরূপ তারা হয়ে পড়েছে অভিশপ্ত। মোদ্দাকথা—সালাত হলো বান্দা ও শয়তানের মাঝে একটা শক্ত বেষ্টনী। একটা মজবুত দেওয়াল। বান্দা যখন নিজেকে সালাতের সাথে যুক্ত রাখে, তখন শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। যে বান্দা নিজেকে সালাতে হাজির রাখে, শয়তানের তির সেই বান্দাকে আঘাত করতে পারে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেই বান্দাকে তাঁর সুরক্ষা-বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। ভাবছেন, এটিও কি আমার কথা? একদম না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই বলেছেন—

    নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে দূরে রাখে।[১]

    সালাত হচ্ছে বর্মের মতো। যতক্ষণ সালাত নামের বর্মটা সত্যিকার অর্থেই আমার দেহের সাথে লেপ্টে থাকবে, ততক্ষণ শত্রুর আঘাত আমাকে আহত করতে পারবে না। শত্রুর সমস্ত আঘাত এই বর্মে লেগে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অথবা সালাতকে আমরা একটা সুরক্ষা-বলয়ের সাথেও তুলনা করতে পারি। যতক্ষণ আমি এই বলয়ের মাঝে থাকবো, ততক্ষণ আমার দ্বারা কোনো মন্দ কাজ সংঘটিত হবে না। সালাত যখন আমার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াবে, তখন যাবতীয় মন্দ কথা, মন্দ ভাবনা আমার অন্তরে আর উদিত হতে পারবে না অথবা উদিত হলেও সেসবের ব্যাপারে আমি বেখেয়াল হবো না। যখনই মন্দ চিন্তা আর মন্দ ভাবনা আমার অন্তরে দখল নিতে চাইবে, তখনই আল্লাহর রহমতে আমার ভেতরে সেসবের ব্যাপারে অনুশোচনা তৈরি হবে এবং আপ্রাণ প্রচেষ্টায় আমি সেগুলোকে আমার ভাবনার জগৎ থেকে মুছে ফেলতে চাইবো।

    কিন্তু যখন আমি সালাত ত্যাগ করবো, যখন সালাতের ব্যাপারে আমার হৃদয়-মন উদাসীন হয়ে উঠবে, তখন আমার অন্তরে ঢুকে পড়বে কুপ্রবৃত্তির হাওয়া। যেহেতু আমার সাথে সালাতের তখন সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে, সেহেতু কুপ্রবৃত্তির আশকারাকে প্রতিহত করার এবং অন্তরে উদিত হওয়া সেই মন্দ ভাবনা আর মন্দ চিন্তাগুলোকে
    [১] সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৫

    লুসাই পাহাড় বেয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসা অপরূপ নদী কর্ণফুলির অঞ্চল থেকে উঠে আসা একজন লেখক আরিফ আজাদ। সত্যের পেছনে নিরন্তর ছুটবার অদম্য নেশা থেকে সাংবাদিক হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জীবন তাকে টেনে এনেছে লেখালেখির জগতে৷ সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি, কিন্তু সত্য এবং সুন্দরে তার যে সবিস্ময় মুগ্ধতা, সেই মুগ্ধতার ঘোর তাকে নিয়ে এসেছে সত্য তুলে ধরবার এমন এক দুনিয়ায়—যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি মিথ্যের কুয়াশাকে মুছে দিতে চান ভোরের ঝলমলে আলো দিয়ে৷

    আরিফ আজাদ লেখালেখির জগতে পদার্পণ করেন ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ লিখে৷ তার পরের ঘটনাপ্রবাহকে যদি এক শব্দে তুলে ধরতে হয়, তবে বলতে হবে – অবিশ্বাস্য! বাংলা সাহিত্যে বিজ প্রথম বই দিয়ে যে কজন লেখক ইতিহাস গড়েছেন, আরিফ আজাদ নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। যেন তিনি রূপকথার সেই বীর যিনি “এলেন, দেখলেন আর জয় করে নিলেন’।

    তবে সেখানেই থেমে যাননি তিনি৷ ‘আরজ আলী সমীপে’, ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ ২’, ‘জীবন যেখানে যেমন’ আর ‘নবি-জীবনের গল্প’-সহ উম্মাহর জন্য উপকারী চমৎকার সব রচনা উপহার দিয়ে সেই জায়গাটিকে তিনি পোক্ত করে চলেছেন অবিরত। তবে ২০২০ বইমেলায় প্রকাশিত ‘বেলা ফুরাবার আগে বইয়ে আরিফ আজাদ হাজির হয়েছেন একেবারেই ভিন্নভাবে৷ মানুষের ভেতর জীবনবোধ জাগানোর জন্য লেখক যেন সমস্ত আয়োজন সাজিয়ে বসেছেন৷ পাঠকনন্দিত সেই ‘বেলা ফুরাবার আগে” বইয়ের দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে লেখক এবার উপস্থিত হয়েছেন ‘এবার ভিন্ন কিছু হোক’ নিয়ে৷

    ভোরের শিশির, শীতের কুয়াশা, রাতের নিস্তব্ধতা, পাখিদের কলরব, নদীর অবিরাম বয়ে চলা, সাগরের বুকে উথাল-পাতাল ঢেউ—সবখানে সবকিছু ঠিকঠাক, কেবল আমাদের জীবনের কোথাও যেন এক নীরব ছন্দপতন৷ সেখানে সুর, তাল আর লয়ের কোনো হিশেব মিলছে না৷ প্রতিদিন একটা একঘেয়েমি চক্রে কেটে যাচ্ছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। মাঝে মাঝে হাপিত্যেশ লাগে—এভাবে একটা জীবন চলতে পারে? কী পাওয়ার বদলে কী হারাচ্ছি জীবন থেকে? এভাবেই কি ক্ষয়ে যাওয়ার কথা আস্ত একটা জীবন?
    প্রশ্নগুলো অনেকের, কিন্তু উত্তরগুলো যেন কোথাও বিন্যস্ত করা নেই৷ জীবনে একটা বদল প্রয়োজন, একটা পরিবর্তন ভীষণ জরুরি—তা আমরা জানি৷ কিন্তু কীভাবে শুরু করবো? ঠিক কোথা থেকে যাত্রা করবো নতুন এক দিনের? এইসব প্রশ্নের উত্তর আর জীবনের এক নতুন উপাখ্যান রচনায় ‘এবার ভিন্ন কিছু হোক” বইটি হতে পারে আপনার নিত্যদিনের সাথি।

    ebar vinno kichu hok pdf free download

  • বেলা ফুরাবার আগে -আরিফ আজাদ

    বেলা ফুরাবার আগে (পেপারব্যাক)
    জীবনের জাগরণ সিরিজ ১

    by আরিফ আজাদ

    কালের ঘূর্ণাবর্তে সবকিছুর পালাবদল ঘটছে। পরিবর্তন আসছে জীবনের রূপ ও রঙে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন চিন্তা এসে গ্রাস করছে পুরোনো চিন্তার জগৎ। এভাবেই চলছে গ্রহণ-বর্জনের নিরন্তর চক্র।
    কালের এই চক্রে সবকিছুতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও একমাত্র ইসলাম-ই চৌদ্দশত বছর ধরে চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান বিকাশের অবিকৃত ও পরিপূর্ণ ধারায় রয়েছে বিরাজমান৷ মানবজাতির জন্য নির্দেশিকা হিসেবে নাযিল হওয়া ইসলামের বার্তাসমূহের রয়েছে সমসাময়িক ও আগামী জীবনের উপযোগিতা৷ ইসলামের সুমহান সেই বার্তাগুলো-ই বিশ্বাসী মানুষের দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘সমকালীন প্রকাশন’-এর পথচলা।

    লেখকের কথা
    ‘সাজিদ সিরিজ’ লেখার পর থেকে, প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষ আমাকে ইনবক্সে, ইমেইলে বিভিন্ন বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলো ভরতি থাকে ভালোবাসা, দুআ আর আশাবাদে। আমি প্রীত হই, আপ্লুত হই, আনন্দিত হই। মানুষের ভালোবাসার যে এক অদ্ভুত শক্তি আছে, তা আমি এই কয়েক বছরে খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছি, আল-হামদু লিল্লাহ। জীবনের একাট্টা ইচ্ছে ছিল সাংবাদিক হওয়ার, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছেটা ছিল ভিন্ন। তিনি আমাকে সাংবাদিক বানাননি, লেখক বানিয়েছেন। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার, মানুষের কাছে পৌঁছানোর যে পথ তিনি আমার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তার শুকরিয়া একজীবনে শেষ করা যাবে না।

    তরুণরা স্বপ্ন নিয়ে আমাকে বলেন, “ভাইয়া, আমি সাজিদ হতে চাই। কীভাবে সাজিদ হওয়া যাবে আমাকে পরামর্শ দিন।’ এমন প্রশ্ন আর আবদারের কাছে আমি মাঝে মাঝে পরাস্ত হই। ভাবি, কী পরামর্শই দেবো? সাজিদ হওয়ার জন্য তাকে বলব অনেক অনেক বই পড়তে? অনেক বেশি জানতে? কিন্তু, পরক্ষণে ভাবি, সাজিদ কি সত্যি এ রকম? আমি কি সাজিদকে এভাবে চেয়েছি কখনো? আমার মানসপটে সাজিদের যে রূপরেখা, সে সাজিদ আসলে কেমন?
    পরে ভাবলাম, তারা যেহেতু সাজিদ হতে চায়, সাজিদ তৈরি করার একটা প্রকল্প হাতে নিতে অসুবিধে নেই কিছু। সাজিদের বিতর্ক আর বক্তব্যের দুনিয়ার সাথে তারা পরিচিত, কিন্তু সাজিদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন, যে জীবনে সাজিদ ভীষণ অন্য রকম, সে জগতের সাথে তাদের পরিচিত করানো উচিত। সাজিদ তৈরির আমার সেই খসড়া প্রস্তাবনা, সেই স্বপ্ন ও সাহসের প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে এ বইটিকে।

    বইটিকে সাজিদ তৈরির প্রথম খসড়া বললেও, মূলত বইয়ের কথাগুলো আত্ম-উন্নয়নমূলক। দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে আমি যে বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছি, হতে পারে সেগুলো দৃশ্য-অদৃশ্য, নিজের সাথে নিজের, কিংবা নিজের সাথে অন্যের—সেই দিকগুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কথা বলেছি অমিত সম্ভাবনার অনন্য দ্বার নিয়েও, যে দ্বার উন্মুক্ত করলেই দেখা মিলবে এক পরম ও পবিত্র জীবনের। ক্ষুদ্র জীবনের অতি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা, অতি সামান্য পড়াশোনা এবং অতি অপরিপক্ব উপলব্ধি থেকে আমি যা বুঝেছি, তার একটি কাগুজে সংকলন এই বইটি। যেহেতু আমরা মানুষ এবং মানুষমাত্রেই ভুল করতে সিদ্ধহস্ত, তাই এ বইতে ভুল থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভুলগুলোর সমস্ত দায়ভার আমার। আর এ বইতে যা কিছু ভালো এবং কল্যাণকর, তার প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার।

    পাঠকের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, এই বইটি যদি আপনার সামান্য উপকারে আসে, যদি এই বই আপনাকে সামান্য পরিমাণও ভাবনার খোরাকি দেয়, তাহলে দয়া করে বইটিকে আপনার নিকট রেখে দেবেন না। আপনার প্রিয় মানুষটি, যার মধ্যেও আপনি চান যে, এই ভাবনার উদয় হোক, তার বরাবর বইটি হস্তান্তর করে দেবেন। আর অবশ্যই, আপনার সালাতে, মুনাজাতে এই অধম বান্দাকে স্মরণ রাখবেন। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
    আরিফ আজাদ
    arifazad.bd@outlook.com

    শুরুর আগে


    প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সাহাবিদের চোখের মণি। তাকে এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টির অন্তরাল করা সাহাবিদের জন্য ছিল রীতিমতো বিচ্ছেদের ব্যাপার। নবিজির উপস্থিতি তাদের হৃদয়কে প্রফুল্ল করে তুলত। তাদের ধ্যানধারণা, তাদের যাপিত জীবনের সকল অনুষঙ্গ আবর্তিত হতো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরেই। ধু-ধু মরুভূমিতে পথহারা পথিকের বুক যেমন এক ফোঁটা পানির জন্য ছটফট করতে থাকে, সাহাবিদের কাছে নবিজির সঙ্গ ছিল ঠিক সে রকম। দুর্লভ, অমৃত সমান পানির মতন। নবিজিকে তারা চোখে হারাতেন। তিনি ছিলেন তাদের কাছে প্রাণের অধিক প্রিয়। যে মানুষটিকে এক পলক না দেখলে সাহাবিরা অস্থির হয়ে উঠতেন, ব্যাকুল হয়ে পড়তেন, যার মুহূর্তকাল অনুপস্থিতি সকলকে দিশেহারা করে তুলত, একদিন সেই মানুষটিই যখন দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে বিদেয় নিলেন, দুনিয়ার জীবন ছেড়ে পাড়ি জমালেন অনন্ত অসীম জীবনের পথে, সাহাবিদের মনের অবস্থা তখন কেমন হয়েছিল? ‘প্রিয়তম মানুষটার সাথে দুনিয়ায় আর দেখা হবে না, একসাথে বসে গল্প করা হবে না, হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ঢেলে ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ” বলে সম্বোধন করা যাবে না, তার ডাকে ‘লাব্বাইক’ বলে হাজির হওয়া হবে না’–এমন দৃশ্যগুলো কল্পনা করা কি সাহাবিদের জন্য খুব সহজ ছিল? ছিল না। নবিজিকে হারিয়ে সাহাবিদের হৃদয়ে যে বিচ্ছেদের ঝড় উঠেছিল, সেই ঝড়ের খানিকটা আমরা বুঝতে পারি উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঐতিহাসিক সেই ঘটনা থেকে।

    নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর দিন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেলেন। ‘নবিজির মৃত্যু হতে পারে’–এই ব্যাপারটা তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তিনি হয়তো ভাবলেন, আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত একজন রাসুল, যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বাছাই করেছেন গোটা মানবজাতির জন্যে, যার ওপর নাযিল হয়েছে আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআন, মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যার সাথে সাত আসমানের ওপরে সাক্ষাৎ করেছেন, তার কীভাবে মৃত্যু হতে পারে? উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন অধিক শোকে পাথর। ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও একজন মানুষ। মানুষ হিশেবে তার মৃত্যু হওয়াটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সৃষ্ট কোনো বস্তুকেই অমরত্ব দান করেননি’ – এই ধ্রুব সত্য থেকে তার মন তখন খানিক সময়ের জন্য বিস্মৃত হলো। নবিজির প্রয়াণ দিবসে এই কথাগুলো বোঝার মতন অবস্থা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর ছিল না। শোকে মুহ্যমান অবস্থায় তিনি গর্জে উঠেন। বললেন, ‘যে বলবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হয়েছে, তাকেই আমি হত্যা করব।’[১]

    ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখমণ্ডল থেকে চাদরটা সরিয়ে, তার শুভ্রোজ্জ্বল চেহারায় দুটো চুমু খেলেন। এরপর উপস্থিত জনতার ঢলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘অবশ্যই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছেন। [২] আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এমন সাদাসিধে সরল বক্তব্যে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর মনের যাতনা যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। নবিজির প্রয়াণে যে শোকের সাগর জন্ম নিয়েছে হৃদয়ে, সেই সাগর যেন আরও অশান্ত, আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, ‘না। কখনোই না। মুনাফিকরা চিরতরে নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হতে পারে না।’ [৩]

    উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুকে এমন বিস্মৃত হতে দেখে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদত করত, তারা জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহ
    [১] তারিখুল ইসলাম, খণ্ড : ১; পৃষ্ঠা : ৩১৭; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড : ৫; পৃষ্ঠা : ১৪২; মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড : ৬; পৃষ্ঠা : ২১৯
    [২] আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৫৩৫; বাংলা
    [৩] তাবাকাতু ইবনি সাদ, খণ্ড : ২; পৃষ্ঠা : ১১৪

    সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইবাদত করে, তারা জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব, চিরন্তন।’[১] এরপর তিনি সুরা আলে ইমরানের সেই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন—
    وما محمد إلا رسول قد خلت من قبله الرسل أفإن مات أو قتل انقلبتم على أعقابكم ومن ينقلب على عقبيه فلن يضر الله شيئا وسيجزى الله الشاكرين
    আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসুল। তার পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসুল বিগত হয়েছেন। যদি মুহাম্মাদ মারা যান কিংবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে কি তোমরা আল্লাহর রাস্তা থেকে পলায়ন করবে? (জেনে রাখো) যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তা থেকে পলায়ন করে, সে আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান প্রদান করবেন । [২]

    আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখে এই আয়াত শুনে মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে যান উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বললেন, ‘মনে হলো এই আয়াত আমি আজই প্রথম শুনলাম!’[৩]
    কজন বিি উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতন একজন বিশিষ্ট সাহাবিও অল্প কিছু সময়ের জন্য বিস্মৃত হয়েছিলেন সেদিন। শোকের আতিশয্যে তিনি ভুলতে বসেছিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। একজন নবি, প্রেরিত রাসুল; আসমানি কিতাবের ধারক-বাহক। জগতে পদচিহ্ন রাখা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এমন মানুষেরও মৃত্যু হতে পারে?—ভাবনার এমন দোটানায়, বিস্মৃতির এমন ঘোরে নিমজ্জিত ছিলেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু। আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখ থেকে কুরআনের একটি আয়াত শুনেই সেদিন তার এই ঘোর ভাঙল। বুঝতে পারলেন, অতি শোকে এক মহাসত্য, এক মহাবাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি। এমন নয় যে, এই আয়াত এর আগে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু শোনেননি। ইতঃপূর্বে অনেক অনেক বার তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেছেন। অনেক মানুষকে তিনি এই আয়াত পড়ে শুনিয়েছেন, শিখিয়েছেন। তারপরও তিনি বললেন, ‘মনে হলো এই আয়াত আমি আজই প্রথম শুনলাম!” এই যে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর একটি

    [১] আর রাহিকুল মাখতুম, ৫৩৫-৫৩৬; বাংলা
    [২] সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৪৪
    [৩] তারিখত তাবারি, খণ্ড : ২; পৃষ্ঠা : ৪৪২; তারিখ ইবনি আসির, খণ্ড : ২; পৃষ্ঠা : ২১৯; সিরাতু ইবনি হিশাম, খণ্ড : ৪; পৃষ্ঠা : ৬৫৬

    মন খারাপের দিনে


    খুব মন খারাপ? হৃদয়ের অন্দরমহলে ভাঙনের জোয়ার? চারপাশের পৃথিবীটাকে বিস্বাদ আর বিরক্তিকর লাগছে? মনে হচ্ছে, আপন মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে? হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জন, প্রিয়মানুষ? কিংবা অযাচিত, অন্যায্য সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত অন্তর? নিন্দুকের নিন্দায় হৃদয়ের গভীরে গভীর দুঃখবোধের প্লাবন? তাহলে চলুন আমরা ঘুরে আসি অন্য একটা জগত থেকে।
    বলছিলাম সেই সময়কার কথা যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করছিল সবচাইতে নিকৃষ্ট, নির্দয়, নরপিশাচ শাসক ফিরাউন। সম্ভবত, পৃথিবী আর কখনোই তার মতন দ্বিতীয় কোনো জালিম শাসককে অবলোকন করবে না। তার অত্যাচার আর নির্যাতনের মাত্রা ছিল অতি ভয়ংকর। হবেই-বা না কেন? নিজেকে সে ‘খোদা’ দাবি করত। খোদার শান, মান আর মর্যাদার আসনে কল্পনা করে সে নিজেকে জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ধরে নিত। তার এই মিথ্যে দাবির সাথে যারাই দ্বিমত করত, তাদের কপালে জুটত—মৃত্যু!

    সেই মৃত্যুগুলো কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না। কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারত, কাউকে পানিতে চুবিয়ে মারত। যেন মৃত্যুর বাহারি আয়োজনে ভরপুর থাকত তার সংসদ।
    ফিরাউন ধরে ধরে বনি ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের হত্যা করত। ফিরাউন জানত, তাকে বধ করার জন্য এই বনি ইসরাইলের মধ্যেই সত্য ইলাহের একজন সত্য নবি প্রেরিত হবে। সে ভাবত, বনি ইসরাইলের ঘরে জন্ম নেওয়া সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করতে পারলেই তার পথের কাঁটা সাফ করে ফেলা যাবে।

    এই নিষ্ঠুর, নির্দয় জালিমের হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল শিশু মুসার মায়ের অন্তর। চোখের সামনে প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন করা দুনিয়ার কোনো বাবা-মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। কীভাবে বাঁচাবেন পুত্রকে তিনি? কীভাবে তাকে আড়াল করবেন জালিম বাহিনীর নাগপাশ থেকে? অস্থির চঞ্চলা হয়ে পড়লেন তিনি। মুসার মায়ের হৃদয়ের এই ব্যাকুলতা আল্লাহর কাছে গোপন থাকল না। তিনি শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে একটা বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য মুসার মাকে নির্দেশ দিলেন। ব্যাপারটা কুরআনে এসেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন—


    وأوحينا إلى أم موسى أن أرضعيه فإذا خفت عليه فألقيه في اليم


    আর আমি মুসার মায়ের নিকট এই মর্মে নির্দেশ পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে।[১]

    চিন্তা করুন। একদিকে ফিরাউন বাহিনীর হাত থেকে সন্তানকে প্রাণে বাঁচাতে মায়ের অন্তর মরিয়া। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, শিশুটাকে যেন বাক্সবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে, এ যেন মৃত্যুর আগেই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া। ডাঙার বাঘের ভয়ে জলের কুমিরের সামনে সন্তানকে ঠেলে দেওয়ার মতন ব্যাপার। আমার এবং আপনার মনে যে ভাবনার উদয় হচ্ছে তা কি মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও উদয় হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছে। তবে, তার মনের সেই ভীতি, সেই ভয়, সেই সন্দেহ তখনই দূর হয়ে গেল, যখন তিনি আল্লাহর কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে পেলেন। সুমহান আল্লাহ বললেন—


    ولا تخافي ولا تحزني إنا تادوه إليك وجاعلوه من المرسلين


    আর একদম ভয় করবে না এবং চিন্তাও করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমার সন্তানকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত করব । (২)

    ওই জায়গায় আমি কিংবা আপনি হলে যে ভয় এবং যে ভীতি আমাদের অন্তরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরত, একই ভয় মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও জেঁকে বসেছিল। তবে তিনি হতোদ্যম হয়ে যাননি। আশা ছেড়ে দেননি। তিনি চোখমুখ বন্ধ করে এমন এক সত্তার ওপর ভরসা করেছিলেন যার দেওয়া আশা কখনো মিথ্যে হয় না। যিনি কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এরপর ফলাফল কী হলো তা আমরা সকলেই জানি। মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রক্ষা করেছিলেন। কেবল রক্ষাই করেননি, যে শত্রু হন্যে হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে ছিল, সেই শত্রুর অন্দরমহলেই শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা বড় করে তুলেছিলেন। এই পরিকল্পনা কার? কে এমন নিখুঁত পরিকল্পনা করার ক্ষমতা রাখেন? তিনি সুমহান আল্লাহ।
    ومكروا ومكر الله والله خير الماكرين
    তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ কৌশল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী [১]

    আমরা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ঘটনাও স্মরণ করতে পারি। শিশু ইউসুফ ছিলেন পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। ইউসুফের প্রতি পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের এই অবর্ণনীয় ভালোবাসাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি তার অন্য সহোদরেরা। হিংসার বশবর্তী হয়ে, খেলার নাম করে তারা ছোট্ট ইউসুফকে ফেলে দেয় এক অন্ধকার কূপের মধ্যে।
    পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে এসে তারা খুব সুন্দর কাহিনি ফেঁদে বসল। বলল, ‘বাবা, খেলার মাঠ থেকে ইউসুফকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে!’ ইয়াকুব আলাইহিস সালাম জানতেন, তার ছেলেরা তার কাছে এসে মিথ্যে কথা বলছে। তিনি এটাও জানতেন, তারা নিশ্চিত ইউসুফের কোনো ক্ষতি করে বসেছে। এতৎসত্ত্বেও তিনি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করলেন না। প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে হারানোর বেদনায় মাথা চাপড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন না। এমনকি ছেলেদের তিনি কোনো কটু কথা, কোনো হুমকি-ধমকি পর্যন্তও দিলেন না। তিনি কী বলেছিলেন জানেন? কুরআনে এসেছে—


    فصبر جميل والله المستعان على ما تصفون

    আমার এত দুঃখ কেন?


    [ক]
    মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট লাগে। বুকের ভেতরে বাসা বাঁধে দুঃখের কালো মেঘ। অবিরাম বৃষ্টিরধারার মতো বিষণ্ণতা এসে আছড়ে পড়ে মনের উঠোনে। আকাশছোঁয়া হিমালয় যেন তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে ভেঙে পড়তে চায় বুকের ওপর। জগৎসংসার তখন বিষাক্ত লাগে।
    মাঝে মাঝে প্রচণ্ড দুঃখবোধে ভেঙে পড়ি আমরা। হয়তো হঠাৎ করে হারিয়ে বসি কোনো প্রিয় মানুষকে। খুব আশা করে থাকি এবারের পৌষের শীতে মায়ের হাতে বানানো ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা খাব বলে। কিন্তু পৌষ আসার আগেই মা হয়তো দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। অথবা, আস্তে আস্তে করে জমানো টাকা, যে টাকা দিয়ে বাবাকে ঈদে উপহার দিয়ে চমকে দেবো ভেবেছিলাম, ঈদ আসার আগেই হয়তো বাবা চলে গেছেন রবের সাক্ষাতে।

    এমনও হতে পারে, ভালো বেতনের কোনো চাকরি হঠাৎ করেই চলে গেল। অথবা, আমার এক বন্ধু আমার সমান যোগ্যতা নিয়ে জীবনে সাঁই সাঁই করে উন্নতি করছে, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। আমার বন্ধু আমার সমান খাটা-খাটুনি করে খুব ভালো রেজাল্ট করছে, কিন্তু আমি পারছি না ।
    পারিবারিক অথবা দাম্পত্য জীবনটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। খেতে নষ্ট হচ্ছে ফসল। উর্বরতা হারাচ্ছে আবাদি জমি। মরে যাচ্ছে গবাদি

    পশু। বন্যায় ভেসে গেছে একমাত্র আশ্রয়। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তিলে তিলে জমানো সম্পদ। মাথার ওপর বেড়েই চলেছে ঋণের বোঝা। আবার, এমনও হতে পারে, কাছের মানুষগুলো আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিও আজ আর ফিরে তাকাচ্ছে না। বাড়ছে দূরত্ব। ভেঙে যাচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন।
    এমন নানান রকম জীবন সমস্যার মুখোমুখি কমবেশি আমরা সকলেই হয়ে থাকি। আমরা ভেঙে পড়ি। ভেতরে ভেতরে গুঁড়িয়ে যাই। আশাহত হই। বিষণ্নতার বিষবাষ্পে ছেঁয়ে যায় আমাদের হৃদয়কোণ। কিন্তু আমাদের সাথে কেন এমনটা হয়?

    আমরা সকলেই ‘পরীক্ষা’ শব্দটির সাথে পরিচিত। স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোতে আমরা পরীক্ষা দিই। পরীক্ষায় পাশের জন্য আমরা দিনরাত পড়াশুনা করি। নোট করি। নিয়মিত ক্লাস করি। দুনিয়ার জীবনটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য ঠিক সে রকম একটা পরীক্ষা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্যই। আমরা তাঁর অনুগত বান্দা কি না তা যাচাইয়ের জন্য। নাহ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অবশ্যই এই যাচাই-বাছাইয়ের ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি আলিমুল গায়েব। ভূত-ভবিষ্যৎ সবকিছুই তিনি জানেন। তিনি জানেন আমাদের মধ্যে কে কে তাঁর অনুগত আর কে কে তাঁর অবাধ্য। চাইলেই তিনি আমাদের দুনিয়াতে না পাঠিয়ে সরাসরি আমাদের রূহ তথা আত্মাগুলোকে হয় জান্নাতে আর না হয় জাহান্নামে দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এমনটি করেননি। কারণ, তিনি আমাদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে চাননি। কী রকম প্রশ্ন? কিয়ামতের মাঠে যাতে আমরা অভিযোগ করে বলতে না পারি, ‘আপনি আমাদের তো পরীক্ষাই করেননি। পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের জাহান্নামে পাঠিয়েছেন। অথচ আমার পরীক্ষা নিলে আজকে আমি

    জাহান্নামের বদলে জান্নাতে থাকতে পারতাম!’
    দুনিয়াকে আল্লাহ তাআলা বানিয়েছেন বিশাল একটা পরীক্ষাকেন্দ্র। আল্লাহ সুবহানাহু
    ওয়া তাআলা কুরআনে বলছেন—
    ولنبلونكم بشيء من الخوف والجوع ونقص من الأموال والأنفس والثمرات وبشر الصابرين

    আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং (তোমাদের) জানমাল ও ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।[১]
    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের পরীক্ষা করবেন ভয়ভীতি দিয়ে। কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনি বাসে করে কোথাও যাচ্ছেন এবং সেই বাসটা হঠাৎ করে দুর্ঘটনার কবলে পড়ল? সেই দুর্ঘটনায় মারা গেছে আপনার পাশের যাত্রীটা, কিন্তু আপনার তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি। হয়েছে এ রকম?
    দূরের যাত্রার বিরক্তি কাটাতে একটু আগেও দুজনে পাশাপাশি দিব্যি খোশগল্প করছিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই আপনার পাশের সেই সহযাত্ৰী এখন মৃত আর আপনি জীবিত রয়ে গেলেন। এই দুর্ঘটনায় কিন্তু আপনারও মৃত্যু হতে পারত। পাশের সহযাত্রীর মতো আপনিও কিন্তু লাশে পরিণত হতে পারতেন। আপনার নামের পাশে ‘আহত’ শব্দের বদলে শোভা পেত “নিহত” শব্দটি। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনাকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। চাক্ষুষ এই ভয়ানক দৃশ্য অবলোকন

    করিয়ে আল্লাহ আপনাকে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান যে, আপনি এই দৃশ্য থেকে শিক্ষা নেন কি না। তাঁর শোকর আদায় করেন কি না। তার অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসেন কি না। তিনি দেখতে চান, এই মৃত্যুর দৃশ্যটা আপনার হৃদয়ে কতটা প্রভাব ফেলে। আপনার বোধোদয় ঘটে কি না। এ রকম বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে আপনি মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে পড়েন কি না—সেটাই হলো আপনার জন্য পরীক্ষা।
    জীবনে এমন আরও বহু ঘটনার সাক্ষী আপনি হতে পারেন। লন্ডনে যাওয়ার জন্য আপনি বুধবার সকালের বিমানের টিকেট চেয়েছেন, কিন্তু পেয়েছেন বুধবার বিকেলের। সকালের টিকেট না পাওয়ায় আপনার প্রচণ্ড মন খারাপ। হতে পারে সকালের টিকেট না পাওয়ায় লন্ডনে কোনো একটা পার্টিতে আপনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। হতে পারে ম্যানচেস্টার শহরের কোনো এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান আপনি মিস করবেন। অস্বাভাবিক নয়।

    কিন্তু সকালের টিকেট না পাওয়াতে একরাশ দুঃখ আর মন খারাপ নিয়ে টিভি খুলে যখন দেখতে পেলেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা সকালের নির্ধারিত সেই ফ্লাইট ক্র্যাশ করেছে এবং নিহত হয়েছে বিমানের সকল যাত্রী, তখন কেমন লাগবে

    পড়াশোনা করার সময় থেকেই লেখালেখির
    আরিফ আজাদ৷ জন্মেছেন চট্টগ্রামে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতেখড়ি৷ ইসলামি সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন৷ ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন৷ বিশ্বাসের কথাগুলোকে শব্দে রূপ দিতে তার জুড়ি নেই৷ ইসলামি ভাবধারাকে কলমের তুলিতে তুলে ধরতে লেখকের রয়েছে মুনশিয়ানা৷ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় লেখকের পাঠকনন্দিত বই ‘আরজ আলী সমীপে’ এবং ২০১৯ সালে তুমুল
    জনপ্রিয় সাজিদ সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ-২’। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন ‘প্রত্যাবর্তন’ আর ‘মা, মা, মা এবং বাবা’ এর মতো জনপ্রিয় বইগুলো৷ ২০২০ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের প্রকাশিত চতুর্থ মৌলিক বই ‘বেলা ফুরাবার আগে।

    bela furabar age pdf free download

  • শেষ -জুনায়েদ ইভান

    ভাদ্র মাসের সকালে হঠাৎ শিহাব একটি কঠিন সমস্যায় পড়েছে। সমস্যাটা এই যে, সে হাসানকে আত্মহত্যা করবার জন্য একটা দড়ি কিনতে পাঠিয়েছে। হাসান শার্ট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হলো। তারপর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যার পর হাতে করে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে ফিরলো ঘরে। পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট থেকে দুটো গোল্ডফিশ রেখে বললো, “এই মাছগুলোকে প্রতিদিন খাবার দিলে একটা সময় পর তারা তাদের মালিককে আলাদা করে চিনতে পারে।”
    শিহাব বললো, “সেটা ঠিক আছে, তোমাকে সকালে দড়ি কিনতে পাঠিয়েছি। আজ বিকেলে পৃথিবী বরাবর তিন পৃষ্ঠার চিঠি লিখে তোমার আত্মহত্যা করবার কথা।’
    হাসান শীতল গলায় বললো, “আমি আত্মহত্যা করব না।”

    ভাদ্র মাসের সকালে হঠাৎ শিহাব একটি কঠিন সমস্যায় পড়েছে। সমস্যাটা এই যে, সে হাসানকে আত্মহত্যা করবার জন্য একটা দড়ি কিনতে পাঠিয়েছে। হাসান শার্ট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হলো। তারপর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যার পর হাতে করে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে ফিরলো ঘরে। পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট থেকে দুটো গোল্ডফিশ রেখে বললো, “এই মাছগুলোকে প্রতিদিন খাবার দিলে একটা সময় পর তারা তাদের মালিককে আলাদা করে চিনতে পারে।”
    শিহাব বললো, “সেটা ঠিক আছে, তোমাকে সকালে দড়ি কিনতে পাঠিয়েছি। আজ বিকেলে পৃথিবী বরাবর তিন পৃষ্ঠার চিঠি লিখে তোমার আত্মহত্যা করবার কথা।’
    হাসান শীতল গলায় বললো, “আমি আত্মহত্যা করব না।”

    “আমি তো তোমাকে এর কারণগুলো বলেছি।”
    হাসান চুপ করে থাকে ।
    শিহাব ক্লান্ত গলায় বললো, “গলায় ফাঁস নিতে ভয় পেলে বিকল্প একটা
    চিন্তা আছে। সুন্দর একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে মারা যেতে চাও?”
    হাসান না সূচক মাথা নাড়ে ।
    “বইয়ের পাতায় পটাসিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে রাখবে। পৃষ্ঠা উল্টানোর সময় আঙুল থেকে জিহ্বায় মিশে গেলেই শেষ।”
    হাসান বললো,“পটাসিয়াম সায়ানাইডের এই উদ্ভট আইডিয়া আপনি কোথা থেকে পেলেন?”
    “ডিটেক্টিভ বই পড়ে।”
    “কিন্তু আমার আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত আপনি কেন নিবেন?”
    “মানুষ কি তার সব সিদ্ধান্ত নিজে নেয়?”

    “আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চান, কিন্তু সেটা আমাকে দিয়ে।”
    ‘আমি কেন তোমাকে মেরে ফেলতে চাইবো? এতে আমার কী স্বার্থ?”
    “কিন্তু আপনি তো তাই করছেন
    “পৃথিবীতে সবাই মরার জন্য আত্মহত্যা করে না। কেউ কেউ বাঁচার জন্য
    করে। আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই।’
    হাসান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করে, “বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে?” “কারণ মানুষ মরতে পারে কিন্তু ভুলতে পারে না।”
    হাসান চুপ করে থাকে।
    শিহাব বললো, “পটাসিয়াম সায়ানাইডে ভয় পেলে বিকল্প আরেকটা চিন্তা আছে । ঘুমের ভেতরে মারা যেতে চাও? স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্নের ভেতরেই অন্য একটা স্বপ্নে চলে গেলে । তারপর আর ফিরে এলে না।”
    শিহাবের কথা শুনে হাসান হেসে ফেলল । বললো, “গুগলে আত্মহত্যা করার সবচেয়ে সহজ উপায় লিখে সার্চ দিলে কী আসে জানেন?”

    “কী?”
    “যতগুলো সার্চ রেজাল্ট পাওয়া যায়, প্রায় সবগুলোতে কাউন্সেলিং


    পৃথিবীতে সবাই মরার জন্য আত্মহত্যা করে না। কেউ কেউ বাঁচার জন্য করে । কারণ মানুষ মরতে পারে কিন্তু ভুলতে পারে না । (সংগৃহীত )



    সেন্টারের ফোন নাম্বার দেয়া থাকে । আর আপনি আমাকে বলছেন, মানুষ
    বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে?”
    শিহাব খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললো, “শব্দটা আত্মহত্যা শোনালেও এর অর্থ হবে আতাবিসর্জন।”

    “আত্মহত্যাকে বলছেন আত্মবিসর্জন?”
    “আমি বলিনি । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। কাদম্বরী দেবী সুইসাইড করার পর লিখেছেন, যে আত্মবিসর্জন করতে পারে, আত্মার উপর শ্রেষ্ঠ অধিকার শুধু তারই জন্মাতে পারে।”
    শিহাবের সাথে হাসানের পরিচয় বছর দুয়েক আগে। রাস্তার দেয়ালে রুমমেট আবশ্যকের বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করে হাসান। দু’ঘরের একটা বাসা। একটা কিচেন, একটা বাথরুম । তারপর সবকিছু চলছিল যেভাবে চলার কথা। শিহাব অবিবাহিত মানুষ । হাসানকে জিজ্ঞাসা করে, “বিয়ে করেছো?” হাসান জবাব না দিয়ে বলে, “আমরা বরং ব্যক্তিগত আলাপ না করি।” তবু নিতান্ত কথার প্রসঙ্গ ধরে একদিন জানা গেল হাসান বিবাহিত। তার স্ত্রী বছর দুয়েক আগে তাকে ফেলে চলে গেছে। শিহাব জিজ্ঞাসা করে,
    “ডিভোর্স?”
    হাসান বলে, “আমরা বরং ব্যক্তিগত আলাপ না করি ।”

    শিহাব রাত জেগে লেখে। একদিন হাসানকে জিজ্ঞাসা করে, টেবিল
    ল্যাম্পের আলোয় তার অসুবিধা হয় কি না।
    হাসান জবাব দেয়, “সমস্যা হলে কি আর লিখবেন না?”
    শিহাব অবাক হয়ে বললো, “লিখব।”
    “তাহলে প্রশ্ন করলেন কেন?”
    ‘সেক্ষেত্রে আমি বসার ঘরে গিয়ে লিখব।” 66
    “মানুষের তুচ্ছ সমস্যাকে এত গুরুত্ব দেন কেন?”
    “মানুষকে না, আমি আমাকে গুরুত্ব দেই। কারো সমস্যা হলে লিখতে
    অসুবিধা হয় ।”
    “কিন্তু আপনি বসার ঘরে গিয়ে লিখলেও আমার সমস্যা হবে।”
    শিহাব জানতে চায়, “কীরকম?”
    “একটা মানুষ আমার জন্য নিজের বিছানায় চিত হয়ে লিখতে পারছে না,

    এই ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে ঘুম আসবে না ।

    “তাহলে কী করতে পারি?” বললো শিহাব ।
    “কিছু করার কথা আসছে কেন? আমি তো বলিনি, আলোতে আমার সমস্যা আছে। তবে নিতুর সমস্যা হতো। সে যখন ঘুমাতো, কবরের মতো অন্ধকার করে ঘুমাতো, যেন শরীরের আলোই একমাত্র আলো।”
    “নিতু কে?”
    “আমার স্ত্রী।”
    শিহাব চুপ করে থাকে। ‘তার স্ত্রী এখন কোথায়’ জানতে চাওয়া সমীচীন হবে কি না ভাবে। হাসান বিছানা থেকে উঠে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে হাত দিয়ে ধোঁয়া তাড়ালো কিছুক্ষণ। বোধহয় সে খুব আয়োজন করে কিছু বলতে চাইছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, যেখান থেকে গল্প শুরু হয়, তার আগে গল্প থাকে । আর, যেখানে শেষ হয় তার পরও গল্প থাকে ।
    হাসান কোথা থেকে শুরু করবে সেটা চিন্তা করার জন্য একটু সময় নিলো ।

    হাসান কোথা থেকে শুরু করবে সেটা চিন্তা করার জন্য একটু সময় নিলো । তারপর বিছানা থেকে উঠে বসে শিহাবের চোখে চোখ রেখে তাকালো । কেউ চোখে চোখ রাখলে শিহাবের তাকে বুঝতে খুব সুবিধা হয়। চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষ মিথ্যে বলতে পারে না, কথাটা আসলে ঠিক না । মিথ্যে বলতে পারে, তবে সেটা তার চোখে ধরা দেয়।
    শিহাব জিজ্ঞাসা করলো, “নিতু কোথায়?”
    হাসান দেয়ালে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করে, “অনেক বছর আগে আমরা দুজন ট্রেন থেকে একটা ভুল স্টেশনে নেমে গিয়েছিলাম । তখন শ্রাবণ মাস । থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি । নিতু হাতে করে বিশাল আকৃতির সুটকেস নিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলো ।
    একে তো বৃষ্টি, তার উপর ভোর। কাছাকাছি কোনো মসজিদের মাইক থেকে আজানের শব্দ। যে কয়টা অটো রিকশা দেখা যাচ্ছে, চালক গায়ে পলিথিন পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছে। ট্রেনে পরিচয়ের সুবাদে ভদ্রতা করে বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, আলো ফুটুক।

    নিতু বললো, “আলো ফুটলে কী হবে?”
    “এখন কোনো রিকশা-সিএনজি কিছু পাবেন না ।”
    মফস্বলের প্ল্যাটফর্ম। অন্ধকার রেললাইন । অপরিচিত দুটো মানুষ একটা

    বৃষ্টিকে কেন্দ্র করে বসে আছি। তখনো দুএকটা হকার দিকবিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিতু ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলো। কবি শেলির কবিতার বই ।

    “কেন জন্ম ও মৃত্যু, স্বপ্ন এবং ভয় ফিরে ফিরে আসে এই পৃথিবীর আলোয় এমন অন্ধকার, মানুষ কেন এমন করে পায়? প্রেম আর ঘৃণা, হতাশা আর আশায়?”
    নিতুর হাতে কবি শেলির বই দেখে আমি বললাম, “মারা যাবার সময় কবির জ্যাকেটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল সফোক্লিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ইডিপাস।”
    সম্ভবত ট্রেনে অচেনা এক আগন্তুকের কাছ থেকে এরকম একটা কথা সে আশা করেনি। এই প্রথম নিতু আমার দিকে ভালো করে তাকালো। তারপর বিস্মিত হয়ে বললো, “কী নাম আপনার?”
    বললাম, “হাসান । ”
    “আমার তো এখন ইডিপাস পড়তে ইচ্ছে করছে। জানি না কবি শেলি বইটা পড়ে শেষ করতে পেরেছিল কি না।”

    আমি তাকে ইডিপাসের গল্প বলতে শুরু করলাম। থিবস নগরের রাজা ইডিপাস । তিনি একদিন প্রচণ্ড অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেবতার অভিশাপে পিতার হত্যাকারী এবং মায়ের শয্যাসঙ্গী হন।
    নিতু মন খারাপ করে থিবস নগরের রাজা ইডিপাসের গল্প শুনছে। “দেবতার এই বাণীর কথা ইডিপাসের পিতা রাজা লাসও জানতেন। তাই তিনি ইডিপাসকে হত্যা করার জন্য এক মেষপালককে দায়িত্ব দেন কিন্তু সেই মেষপালক তাকে হত্যা না করে অন্য এক মেষপালকের হাতে তুলে দেন। ঘটনা চক্রে ইডিপাসের ঠাঁই হয় অন্য এক দেশের নিঃসন্তান রাজা পলিবাসের হাতে। একটু একটু করে বড়ো হতে শুরু করে ইডিপাস। তারপর একদিন সেও শুনলো সেই দেবতার কথা, তুমিই হবে পিতার হত্যাকারী এবং মায়ের শয্যাসঙ্গী!”
    আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিতু জিজ্ঞাসা করলো, “দেবতার অভিশাপ এরকম
    কেন হবে?”

    প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি বেড়ে চলেছে। আমরা দুজন অপরিচিত মানুষ আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করছি। এর ভেতরে ইডিপাসের গল্প আমাদের কোথায় যেন নিয়ে গেল । এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি বোধহয় এই মানুষটাকে খুঁজেছি। নিতু দেখতে শ্যামলা। কেমন যেন হলদে হলদে গায়ের রং ।
    আলো ফোটার পর আবিষ্কার করি, আমরা দুজন ভুল স্টেশনে নেমে পড়েছি। বিশাল আকৃতির সুটকেস নিয়ে নিতু বেশ অস্থির হয়ে উঠলো । আমার দারুণ লাগছিল ।
    কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন ঘটে তখনই বুঝতে পারা যায়, এই মুহূর্ত গুলো জীবনে থেকে যাবার জন্য এসেছে। যদি স্টেশন ভুল না হতো? যদি রিকশাওয়ালা পলিথিন প্যাচিয়ে না ঘুমোতো! যদি ঠিক সেই সময় কবি শেলির উপস্থিতি না ঘটতো? ‘এতগুলো ভুল’, ‘এতগুলো যদি’ একটার পর একটা
    সিকোয়েন্স মিলিয়ে কেন সামনে এলো?

    সেদিনের সকালটাকে মনে হয়েছিল, এর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই । গন্তব্য
    নেই । জীবন ও জগতের এ এক আশ্চর্য রকমের মোহ।
    নিতুকে বললাম, “সকাল আটটায় একটা লোকাল ট্রেন থামবে। সেখানে উঠে পরের স্টেশনে নেমে যাবো আমরা। 99
    মাঝের সময়টা বসে ছিলাম প্ল্যাটফর্মে। জিজ্ঞাসা করলাম, “খিদে
    পেয়েছে?”
    নিতু না সূচক মাথা নাড়ে ।
    “এদিকে আগে আসা হয়নি বুঝি?”
    নিতু চুপ করে থাকে। কোথায় কীরকম একটা বিভীষিকার ছাপ তার চোখে-মুখে ।
    বললাম, “আমি অফিসের একটি কাজে এসেছি। সপ্তাহখানেক থাকবো।” নিতু বললো, “আমি পালিয়ে এসেছি। কতদিন থাকবো জানি না।” বলেই
    ব্যাগ থেকে কবি শেলির বইটি বের করে পড়তে শুরু করে।
    “তুমি বছরের শেষ গীত
    তার শব-মিছিলের শোকার্ত সঙ্গীত
    এই শেষ অন্ধকার রাত
    বছরের কবর গৃহের অর্ধ-গোলাকার ছাদ”

    নেহাত কথার প্রসঙ্গ ধরে ব্যক্তিগত আলাপের যে গল্প, সেই গল্পের হাত ধরে একদিন শিহাব সিদ্ধান্ত নেয়, হাসানকে সে আত্মহত্যা করতে বলবে । তারপর দিনের পর দিন হাসানের সাথে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা কম হয়নি। এমতাবস্থায় একদিন এক সমঝোতা হয় তাদের মাঝে । হাসান সম্মতি জানিয়ে বলে, চলে যাবার আগে পৃথিবী বরাবর কিছু লিখে যেতে চায় । সেই চিঠি শেষ করে হাসান আত্মহত্যা করবার জন্য দড়ি কিনতে ঘর থেকে বের হয়। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায় সে ফেরে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে। সে আত্মহত্যা করবে না ।

    sesh zunayed evan pdf



  • The Power of Positive Thinking দ্য পাওয়ার অব্ পজিটিভ থিংকিং Book pdf free download

    The Power of Positive Thinking দ্য পাওয়ার অব্ পজিটিভ থিংকিং Book

    বইটি পেতে কমেন্টে email দিন