Journey from the self to the Self and find the mine of gold. Leave behind what is sour and bitter and move toward the sweet.

বেলা ফুরাবার আগে -আরিফ আজাদ

বেলা ফুরাবার আগে (পেপারব্যাক)
জীবনের জাগরণ সিরিজ ১

by আরিফ আজাদ

কালের ঘূর্ণাবর্তে সবকিছুর পালাবদল ঘটছে। পরিবর্তন আসছে জীবনের রূপ ও রঙে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন চিন্তা এসে গ্রাস করছে পুরোনো চিন্তার জগৎ। এভাবেই চলছে গ্রহণ-বর্জনের নিরন্তর চক্র।
কালের এই চক্রে সবকিছুতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও একমাত্র ইসলাম-ই চৌদ্দশত বছর ধরে চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান বিকাশের অবিকৃত ও পরিপূর্ণ ধারায় রয়েছে বিরাজমান৷ মানবজাতির জন্য নির্দেশিকা হিসেবে নাযিল হওয়া ইসলামের বার্তাসমূহের রয়েছে সমসাময়িক ও আগামী জীবনের উপযোগিতা৷ ইসলামের সুমহান সেই বার্তাগুলো-ই বিশ্বাসী মানুষের দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘সমকালীন প্রকাশন’-এর পথচলা।

লেখকের কথা
‘সাজিদ সিরিজ’ লেখার পর থেকে, প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষ আমাকে ইনবক্সে, ইমেইলে বিভিন্ন বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলো ভরতি থাকে ভালোবাসা, দুআ আর আশাবাদে। আমি প্রীত হই, আপ্লুত হই, আনন্দিত হই। মানুষের ভালোবাসার যে এক অদ্ভুত শক্তি আছে, তা আমি এই কয়েক বছরে খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছি, আল-হামদু লিল্লাহ। জীবনের একাট্টা ইচ্ছে ছিল সাংবাদিক হওয়ার, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছেটা ছিল ভিন্ন। তিনি আমাকে সাংবাদিক বানাননি, লেখক বানিয়েছেন। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার, মানুষের কাছে পৌঁছানোর যে পথ তিনি আমার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তার শুকরিয়া একজীবনে শেষ করা যাবে না।

তরুণরা স্বপ্ন নিয়ে আমাকে বলেন, “ভাইয়া, আমি সাজিদ হতে চাই। কীভাবে সাজিদ হওয়া যাবে আমাকে পরামর্শ দিন।’ এমন প্রশ্ন আর আবদারের কাছে আমি মাঝে মাঝে পরাস্ত হই। ভাবি, কী পরামর্শই দেবো? সাজিদ হওয়ার জন্য তাকে বলব অনেক অনেক বই পড়তে? অনেক বেশি জানতে? কিন্তু, পরক্ষণে ভাবি, সাজিদ কি সত্যি এ রকম? আমি কি সাজিদকে এভাবে চেয়েছি কখনো? আমার মানসপটে সাজিদের যে রূপরেখা, সে সাজিদ আসলে কেমন?
পরে ভাবলাম, তারা যেহেতু সাজিদ হতে চায়, সাজিদ তৈরি করার একটা প্রকল্প হাতে নিতে অসুবিধে নেই কিছু। সাজিদের বিতর্ক আর বক্তব্যের দুনিয়ার সাথে তারা পরিচিত, কিন্তু সাজিদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন, যে জীবনে সাজিদ ভীষণ অন্য রকম, সে জগতের সাথে তাদের পরিচিত করানো উচিত। সাজিদ তৈরির আমার সেই খসড়া প্রস্তাবনা, সেই স্বপ্ন ও সাহসের প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে এ বইটিকে।

বইটিকে সাজিদ তৈরির প্রথম খসড়া বললেও, মূলত বইয়ের কথাগুলো আত্ম-উন্নয়নমূলক। দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে আমি যে বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছি, হতে পারে সেগুলো দৃশ্য-অদৃশ্য, নিজের সাথে নিজের, কিংবা নিজের সাথে অন্যের—সেই দিকগুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কথা বলেছি অমিত সম্ভাবনার অনন্য দ্বার নিয়েও, যে দ্বার উন্মুক্ত করলেই দেখা মিলবে এক পরম ও পবিত্র জীবনের। ক্ষুদ্র জীবনের অতি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা, অতি সামান্য পড়াশোনা এবং অতি অপরিপক্ব উপলব্ধি থেকে আমি যা বুঝেছি, তার একটি কাগুজে সংকলন এই বইটি। যেহেতু আমরা মানুষ এবং মানুষমাত্রেই ভুল করতে সিদ্ধহস্ত, তাই এ বইতে ভুল থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভুলগুলোর সমস্ত দায়ভার আমার। আর এ বইতে যা কিছু ভালো এবং কল্যাণকর, তার প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার।

পাঠকের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, এই বইটি যদি আপনার সামান্য উপকারে আসে, যদি এই বই আপনাকে সামান্য পরিমাণও ভাবনার খোরাকি দেয়, তাহলে দয়া করে বইটিকে আপনার নিকট রেখে দেবেন না। আপনার প্রিয় মানুষটি, যার মধ্যেও আপনি চান যে, এই ভাবনার উদয় হোক, তার বরাবর বইটি হস্তান্তর করে দেবেন। আর অবশ্যই, আপনার সালাতে, মুনাজাতে এই অধম বান্দাকে স্মরণ রাখবেন। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
আরিফ আজাদ
arifazad.bd@outlook.com

শুরুর আগে


প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সাহাবিদের চোখের মণি। তাকে এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টির অন্তরাল করা সাহাবিদের জন্য ছিল রীতিমতো বিচ্ছেদের ব্যাপার। নবিজির উপস্থিতি তাদের হৃদয়কে প্রফুল্ল করে তুলত। তাদের ধ্যানধারণা, তাদের যাপিত জীবনের সকল অনুষঙ্গ আবর্তিত হতো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরেই। ধু-ধু মরুভূমিতে পথহারা পথিকের বুক যেমন এক ফোঁটা পানির জন্য ছটফট করতে থাকে, সাহাবিদের কাছে নবিজির সঙ্গ ছিল ঠিক সে রকম। দুর্লভ, অমৃত সমান পানির মতন। নবিজিকে তারা চোখে হারাতেন। তিনি ছিলেন তাদের কাছে প্রাণের অধিক প্রিয়। যে মানুষটিকে এক পলক না দেখলে সাহাবিরা অস্থির হয়ে উঠতেন, ব্যাকুল হয়ে পড়তেন, যার মুহূর্তকাল অনুপস্থিতি সকলকে দিশেহারা করে তুলত, একদিন সেই মানুষটিই যখন দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে বিদেয় নিলেন, দুনিয়ার জীবন ছেড়ে পাড়ি জমালেন অনন্ত অসীম জীবনের পথে, সাহাবিদের মনের অবস্থা তখন কেমন হয়েছিল? ‘প্রিয়তম মানুষটার সাথে দুনিয়ায় আর দেখা হবে না, একসাথে বসে গল্প করা হবে না, হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ঢেলে ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ” বলে সম্বোধন করা যাবে না, তার ডাকে ‘লাব্বাইক’ বলে হাজির হওয়া হবে না’–এমন দৃশ্যগুলো কল্পনা করা কি সাহাবিদের জন্য খুব সহজ ছিল? ছিল না। নবিজিকে হারিয়ে সাহাবিদের হৃদয়ে যে বিচ্ছেদের ঝড় উঠেছিল, সেই ঝড়ের খানিকটা আমরা বুঝতে পারি উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঐতিহাসিক সেই ঘটনা থেকে।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর দিন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেলেন। ‘নবিজির মৃত্যু হতে পারে’–এই ব্যাপারটা তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তিনি হয়তো ভাবলেন, আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত একজন রাসুল, যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বাছাই করেছেন গোটা মানবজাতির জন্যে, যার ওপর নাযিল হয়েছে আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআন, মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যার সাথে সাত আসমানের ওপরে সাক্ষাৎ করেছেন, তার কীভাবে মৃত্যু হতে পারে? উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন অধিক শোকে পাথর। ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও একজন মানুষ। মানুষ হিশেবে তার মৃত্যু হওয়াটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সৃষ্ট কোনো বস্তুকেই অমরত্ব দান করেননি’ – এই ধ্রুব সত্য থেকে তার মন তখন খানিক সময়ের জন্য বিস্মৃত হলো। নবিজির প্রয়াণ দিবসে এই কথাগুলো বোঝার মতন অবস্থা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর ছিল না। শোকে মুহ্যমান অবস্থায় তিনি গর্জে উঠেন। বললেন, ‘যে বলবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হয়েছে, তাকেই আমি হত্যা করব।’[১]

ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখমণ্ডল থেকে চাদরটা সরিয়ে, তার শুভ্রোজ্জ্বল চেহারায় দুটো চুমু খেলেন। এরপর উপস্থিত জনতার ঢলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘অবশ্যই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছেন। [২] আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এমন সাদাসিধে সরল বক্তব্যে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর মনের যাতনা যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। নবিজির প্রয়াণে যে শোকের সাগর জন্ম নিয়েছে হৃদয়ে, সেই সাগর যেন আরও অশান্ত, আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, ‘না। কখনোই না। মুনাফিকরা চিরতরে নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হতে পারে না।’ [৩]

উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুকে এমন বিস্মৃত হতে দেখে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদত করত, তারা জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহ
[১] তারিখুল ইসলাম, খণ্ড : ১; পৃষ্ঠা : ৩১৭; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড : ৫; পৃষ্ঠা : ১৪২; মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড : ৬; পৃষ্ঠা : ২১৯
[২] আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৫৩৫; বাংলা
[৩] তাবাকাতু ইবনি সাদ, খণ্ড : ২; পৃষ্ঠা : ১১৪

সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইবাদত করে, তারা জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব, চিরন্তন।’[১] এরপর তিনি সুরা আলে ইমরানের সেই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন—
وما محمد إلا رسول قد خلت من قبله الرسل أفإن مات أو قتل انقلبتم على أعقابكم ومن ينقلب على عقبيه فلن يضر الله شيئا وسيجزى الله الشاكرين
আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসুল। তার পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসুল বিগত হয়েছেন। যদি মুহাম্মাদ মারা যান কিংবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে কি তোমরা আল্লাহর রাস্তা থেকে পলায়ন করবে? (জেনে রাখো) যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তা থেকে পলায়ন করে, সে আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান প্রদান করবেন । [২]

আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখে এই আয়াত শুনে মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে যান উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বললেন, ‘মনে হলো এই আয়াত আমি আজই প্রথম শুনলাম!’[৩]
কজন বিি উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতন একজন বিশিষ্ট সাহাবিও অল্প কিছু সময়ের জন্য বিস্মৃত হয়েছিলেন সেদিন। শোকের আতিশয্যে তিনি ভুলতে বসেছিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। একজন নবি, প্রেরিত রাসুল; আসমানি কিতাবের ধারক-বাহক। জগতে পদচিহ্ন রাখা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এমন মানুষেরও মৃত্যু হতে পারে?—ভাবনার এমন দোটানায়, বিস্মৃতির এমন ঘোরে নিমজ্জিত ছিলেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু। আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখ থেকে কুরআনের একটি আয়াত শুনেই সেদিন তার এই ঘোর ভাঙল। বুঝতে পারলেন, অতি শোকে এক মহাসত্য, এক মহাবাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি। এমন নয় যে, এই আয়াত এর আগে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু শোনেননি। ইতঃপূর্বে অনেক অনেক বার তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেছেন। অনেক মানুষকে তিনি এই আয়াত পড়ে শুনিয়েছেন, শিখিয়েছেন। তারপরও তিনি বললেন, ‘মনে হলো এই আয়াত আমি আজই প্রথম শুনলাম!” এই যে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর একটি

[১] আর রাহিকুল মাখতুম, ৫৩৫-৫৩৬; বাংলা
[২] সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৪৪
[৩] তারিখত তাবারি, খণ্ড : ২; পৃষ্ঠা : ৪৪২; তারিখ ইবনি আসির, খণ্ড : ২; পৃষ্ঠা : ২১৯; সিরাতু ইবনি হিশাম, খণ্ড : ৪; পৃষ্ঠা : ৬৫৬

মন খারাপের দিনে


খুব মন খারাপ? হৃদয়ের অন্দরমহলে ভাঙনের জোয়ার? চারপাশের পৃথিবীটাকে বিস্বাদ আর বিরক্তিকর লাগছে? মনে হচ্ছে, আপন মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে? হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জন, প্রিয়মানুষ? কিংবা অযাচিত, অন্যায্য সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত অন্তর? নিন্দুকের নিন্দায় হৃদয়ের গভীরে গভীর দুঃখবোধের প্লাবন? তাহলে চলুন আমরা ঘুরে আসি অন্য একটা জগত থেকে।
বলছিলাম সেই সময়কার কথা যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করছিল সবচাইতে নিকৃষ্ট, নির্দয়, নরপিশাচ শাসক ফিরাউন। সম্ভবত, পৃথিবী আর কখনোই তার মতন দ্বিতীয় কোনো জালিম শাসককে অবলোকন করবে না। তার অত্যাচার আর নির্যাতনের মাত্রা ছিল অতি ভয়ংকর। হবেই-বা না কেন? নিজেকে সে ‘খোদা’ দাবি করত। খোদার শান, মান আর মর্যাদার আসনে কল্পনা করে সে নিজেকে জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ধরে নিত। তার এই মিথ্যে দাবির সাথে যারাই দ্বিমত করত, তাদের কপালে জুটত—মৃত্যু!

সেই মৃত্যুগুলো কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না। কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারত, কাউকে পানিতে চুবিয়ে মারত। যেন মৃত্যুর বাহারি আয়োজনে ভরপুর থাকত তার সংসদ।
ফিরাউন ধরে ধরে বনি ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের হত্যা করত। ফিরাউন জানত, তাকে বধ করার জন্য এই বনি ইসরাইলের মধ্যেই সত্য ইলাহের একজন সত্য নবি প্রেরিত হবে। সে ভাবত, বনি ইসরাইলের ঘরে জন্ম নেওয়া সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করতে পারলেই তার পথের কাঁটা সাফ করে ফেলা যাবে।

এই নিষ্ঠুর, নির্দয় জালিমের হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল শিশু মুসার মায়ের অন্তর। চোখের সামনে প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন করা দুনিয়ার কোনো বাবা-মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। কীভাবে বাঁচাবেন পুত্রকে তিনি? কীভাবে তাকে আড়াল করবেন জালিম বাহিনীর নাগপাশ থেকে? অস্থির চঞ্চলা হয়ে পড়লেন তিনি। মুসার মায়ের হৃদয়ের এই ব্যাকুলতা আল্লাহর কাছে গোপন থাকল না। তিনি শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে একটা বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য মুসার মাকে নির্দেশ দিলেন। ব্যাপারটা কুরআনে এসেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন—


وأوحينا إلى أم موسى أن أرضعيه فإذا خفت عليه فألقيه في اليم


আর আমি মুসার মায়ের নিকট এই মর্মে নির্দেশ পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে।[১]

চিন্তা করুন। একদিকে ফিরাউন বাহিনীর হাত থেকে সন্তানকে প্রাণে বাঁচাতে মায়ের অন্তর মরিয়া। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, শিশুটাকে যেন বাক্সবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে, এ যেন মৃত্যুর আগেই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া। ডাঙার বাঘের ভয়ে জলের কুমিরের সামনে সন্তানকে ঠেলে দেওয়ার মতন ব্যাপার। আমার এবং আপনার মনে যে ভাবনার উদয় হচ্ছে তা কি মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও উদয় হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছে। তবে, তার মনের সেই ভীতি, সেই ভয়, সেই সন্দেহ তখনই দূর হয়ে গেল, যখন তিনি আল্লাহর কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে পেলেন। সুমহান আল্লাহ বললেন—


ولا تخافي ولا تحزني إنا تادوه إليك وجاعلوه من المرسلين


আর একদম ভয় করবে না এবং চিন্তাও করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমার সন্তানকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত করব । (২)

ওই জায়গায় আমি কিংবা আপনি হলে যে ভয় এবং যে ভীতি আমাদের অন্তরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরত, একই ভয় মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও জেঁকে বসেছিল। তবে তিনি হতোদ্যম হয়ে যাননি। আশা ছেড়ে দেননি। তিনি চোখমুখ বন্ধ করে এমন এক সত্তার ওপর ভরসা করেছিলেন যার দেওয়া আশা কখনো মিথ্যে হয় না। যিনি কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এরপর ফলাফল কী হলো তা আমরা সকলেই জানি। মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রক্ষা করেছিলেন। কেবল রক্ষাই করেননি, যে শত্রু হন্যে হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে ছিল, সেই শত্রুর অন্দরমহলেই শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা বড় করে তুলেছিলেন। এই পরিকল্পনা কার? কে এমন নিখুঁত পরিকল্পনা করার ক্ষমতা রাখেন? তিনি সুমহান আল্লাহ।
ومكروا ومكر الله والله خير الماكرين
তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ কৌশল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী [১]

আমরা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ঘটনাও স্মরণ করতে পারি। শিশু ইউসুফ ছিলেন পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। ইউসুফের প্রতি পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের এই অবর্ণনীয় ভালোবাসাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি তার অন্য সহোদরেরা। হিংসার বশবর্তী হয়ে, খেলার নাম করে তারা ছোট্ট ইউসুফকে ফেলে দেয় এক অন্ধকার কূপের মধ্যে।
পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে এসে তারা খুব সুন্দর কাহিনি ফেঁদে বসল। বলল, ‘বাবা, খেলার মাঠ থেকে ইউসুফকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে!’ ইয়াকুব আলাইহিস সালাম জানতেন, তার ছেলেরা তার কাছে এসে মিথ্যে কথা বলছে। তিনি এটাও জানতেন, তারা নিশ্চিত ইউসুফের কোনো ক্ষতি করে বসেছে। এতৎসত্ত্বেও তিনি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করলেন না। প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে হারানোর বেদনায় মাথা চাপড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন না। এমনকি ছেলেদের তিনি কোনো কটু কথা, কোনো হুমকি-ধমকি পর্যন্তও দিলেন না। তিনি কী বলেছিলেন জানেন? কুরআনে এসেছে—


فصبر جميل والله المستعان على ما تصفون

আমার এত দুঃখ কেন?


[ক]
মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট লাগে। বুকের ভেতরে বাসা বাঁধে দুঃখের কালো মেঘ। অবিরাম বৃষ্টিরধারার মতো বিষণ্ণতা এসে আছড়ে পড়ে মনের উঠোনে। আকাশছোঁয়া হিমালয় যেন তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে ভেঙে পড়তে চায় বুকের ওপর। জগৎসংসার তখন বিষাক্ত লাগে।
মাঝে মাঝে প্রচণ্ড দুঃখবোধে ভেঙে পড়ি আমরা। হয়তো হঠাৎ করে হারিয়ে বসি কোনো প্রিয় মানুষকে। খুব আশা করে থাকি এবারের পৌষের শীতে মায়ের হাতে বানানো ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা খাব বলে। কিন্তু পৌষ আসার আগেই মা হয়তো দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। অথবা, আস্তে আস্তে করে জমানো টাকা, যে টাকা দিয়ে বাবাকে ঈদে উপহার দিয়ে চমকে দেবো ভেবেছিলাম, ঈদ আসার আগেই হয়তো বাবা চলে গেছেন রবের সাক্ষাতে।

এমনও হতে পারে, ভালো বেতনের কোনো চাকরি হঠাৎ করেই চলে গেল। অথবা, আমার এক বন্ধু আমার সমান যোগ্যতা নিয়ে জীবনে সাঁই সাঁই করে উন্নতি করছে, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। আমার বন্ধু আমার সমান খাটা-খাটুনি করে খুব ভালো রেজাল্ট করছে, কিন্তু আমি পারছি না ।
পারিবারিক অথবা দাম্পত্য জীবনটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। খেতে নষ্ট হচ্ছে ফসল। উর্বরতা হারাচ্ছে আবাদি জমি। মরে যাচ্ছে গবাদি

পশু। বন্যায় ভেসে গেছে একমাত্র আশ্রয়। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তিলে তিলে জমানো সম্পদ। মাথার ওপর বেড়েই চলেছে ঋণের বোঝা। আবার, এমনও হতে পারে, কাছের মানুষগুলো আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিও আজ আর ফিরে তাকাচ্ছে না। বাড়ছে দূরত্ব। ভেঙে যাচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন।
এমন নানান রকম জীবন সমস্যার মুখোমুখি কমবেশি আমরা সকলেই হয়ে থাকি। আমরা ভেঙে পড়ি। ভেতরে ভেতরে গুঁড়িয়ে যাই। আশাহত হই। বিষণ্নতার বিষবাষ্পে ছেঁয়ে যায় আমাদের হৃদয়কোণ। কিন্তু আমাদের সাথে কেন এমনটা হয়?

আমরা সকলেই ‘পরীক্ষা’ শব্দটির সাথে পরিচিত। স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোতে আমরা পরীক্ষা দিই। পরীক্ষায় পাশের জন্য আমরা দিনরাত পড়াশুনা করি। নোট করি। নিয়মিত ক্লাস করি। দুনিয়ার জীবনটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য ঠিক সে রকম একটা পরীক্ষা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্যই। আমরা তাঁর অনুগত বান্দা কি না তা যাচাইয়ের জন্য। নাহ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অবশ্যই এই যাচাই-বাছাইয়ের ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি আলিমুল গায়েব। ভূত-ভবিষ্যৎ সবকিছুই তিনি জানেন। তিনি জানেন আমাদের মধ্যে কে কে তাঁর অনুগত আর কে কে তাঁর অবাধ্য। চাইলেই তিনি আমাদের দুনিয়াতে না পাঠিয়ে সরাসরি আমাদের রূহ তথা আত্মাগুলোকে হয় জান্নাতে আর না হয় জাহান্নামে দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এমনটি করেননি। কারণ, তিনি আমাদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে চাননি। কী রকম প্রশ্ন? কিয়ামতের মাঠে যাতে আমরা অভিযোগ করে বলতে না পারি, ‘আপনি আমাদের তো পরীক্ষাই করেননি। পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের জাহান্নামে পাঠিয়েছেন। অথচ আমার পরীক্ষা নিলে আজকে আমি

জাহান্নামের বদলে জান্নাতে থাকতে পারতাম!’
দুনিয়াকে আল্লাহ তাআলা বানিয়েছেন বিশাল একটা পরীক্ষাকেন্দ্র। আল্লাহ সুবহানাহু
ওয়া তাআলা কুরআনে বলছেন—
ولنبلونكم بشيء من الخوف والجوع ونقص من الأموال والأنفس والثمرات وبشر الصابرين

আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং (তোমাদের) জানমাল ও ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।[১]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের পরীক্ষা করবেন ভয়ভীতি দিয়ে। কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনি বাসে করে কোথাও যাচ্ছেন এবং সেই বাসটা হঠাৎ করে দুর্ঘটনার কবলে পড়ল? সেই দুর্ঘটনায় মারা গেছে আপনার পাশের যাত্রীটা, কিন্তু আপনার তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি। হয়েছে এ রকম?
দূরের যাত্রার বিরক্তি কাটাতে একটু আগেও দুজনে পাশাপাশি দিব্যি খোশগল্প করছিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই আপনার পাশের সেই সহযাত্ৰী এখন মৃত আর আপনি জীবিত রয়ে গেলেন। এই দুর্ঘটনায় কিন্তু আপনারও মৃত্যু হতে পারত। পাশের সহযাত্রীর মতো আপনিও কিন্তু লাশে পরিণত হতে পারতেন। আপনার নামের পাশে ‘আহত’ শব্দের বদলে শোভা পেত “নিহত” শব্দটি। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনাকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। চাক্ষুষ এই ভয়ানক দৃশ্য অবলোকন

করিয়ে আল্লাহ আপনাকে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান যে, আপনি এই দৃশ্য থেকে শিক্ষা নেন কি না। তাঁর শোকর আদায় করেন কি না। তার অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসেন কি না। তিনি দেখতে চান, এই মৃত্যুর দৃশ্যটা আপনার হৃদয়ে কতটা প্রভাব ফেলে। আপনার বোধোদয় ঘটে কি না। এ রকম বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে আপনি মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে পড়েন কি না—সেটাই হলো আপনার জন্য পরীক্ষা।
জীবনে এমন আরও বহু ঘটনার সাক্ষী আপনি হতে পারেন। লন্ডনে যাওয়ার জন্য আপনি বুধবার সকালের বিমানের টিকেট চেয়েছেন, কিন্তু পেয়েছেন বুধবার বিকেলের। সকালের টিকেট না পাওয়ায় আপনার প্রচণ্ড মন খারাপ। হতে পারে সকালের টিকেট না পাওয়ায় লন্ডনে কোনো একটা পার্টিতে আপনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। হতে পারে ম্যানচেস্টার শহরের কোনো এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান আপনি মিস করবেন। অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু সকালের টিকেট না পাওয়াতে একরাশ দুঃখ আর মন খারাপ নিয়ে টিভি খুলে যখন দেখতে পেলেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা সকালের নির্ধারিত সেই ফ্লাইট ক্র্যাশ করেছে এবং নিহত হয়েছে বিমানের সকল যাত্রী, তখন কেমন লাগবে

পড়াশোনা করার সময় থেকেই লেখালেখির
আরিফ আজাদ৷ জন্মেছেন চট্টগ্রামে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতেখড়ি৷ ইসলামি সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন৷ ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন৷ বিশ্বাসের কথাগুলোকে শব্দে রূপ দিতে তার জুড়ি নেই৷ ইসলামি ভাবধারাকে কলমের তুলিতে তুলে ধরতে লেখকের রয়েছে মুনশিয়ানা৷ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় লেখকের পাঠকনন্দিত বই ‘আরজ আলী সমীপে’ এবং ২০১৯ সালে তুমুল
জনপ্রিয় সাজিদ সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ-২’। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন ‘প্রত্যাবর্তন’ আর ‘মা, মা, মা এবং বাবা’ এর মতো জনপ্রিয় বইগুলো৷ ২০২০ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের প্রকাশিত চতুর্থ মৌলিক বই ‘বেলা ফুরাবার আগে।

bela furabar age pdf free download

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

Leave a Reply