Give, even if you only have a little.

— Buddha

দুর্বার মুক্তিযুদ্ধা

বেশ কিছুদিন থেকেই বিজয় দিবস নিয়ে কিছু একটা লিখবো মনস্থির করতেই নানা চিন্তা মাথায় এসে জট লাগিয়ে দিচ্ছিলো।এক লাইন লিখে সেটা আবার কেটে দেই।পৃষ্ঠার কোণায় ক্ষানিকক্ষণ লতা-পাতা,গাছ-পালা,ফুলের ছবি আঁকি।নিজহাতে বানানো তিতকুটে স্বাদের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকি রুমের দক্ষিণা জানালার সামনে(মোটকথা ভাব নেয়ার চেষ্টা করি বিরাট বড় লেখক হয়ে গেছি!)তবুও তো কোন লেখা মাথায় আসে না।অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম,লিখবো না।লিখবোই না।গোল্লায় যাক লেখালেখি।হুহ!বেড়িয়ে গেলাম বাসার পেছনের রাস্তায়।সাথী ছাড়া শীতের সকালে হাঁটতে একটু ভয় ভয় লাগছিলো।একটু এগুতেই অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা মিলে গেল বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান দাদুর সঙ্গে। ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসার পর প্রসঙ্গ ছাড়াই বললাম,”দাদুভাই আপনি তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধা,যদি আপনি যুদ্ধের দিনের কোনো অবিস্মরণীয় ঘটনা শুনাতেন,তাহলে হয়তো শীতের সকালটা গরমের আমেজেই কেটে যেতো”।

তিনি কোনরূপ ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলেন_সময়টা ১৯৭১ সালের……মার্চ মাসের শেষ আর এপ্রিলের শুরুর দিকে। সবেমাত্র বর্ষা আসতে শুরু করেছে। হঠাৎ একদিন সূর্যের খরতাপের মধ্যেই কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিলো। শুরু হয়েছিলো মেঘের গুরু গুরু গর্জন।

দিগ্বিজগী যুদ্ধার কামানের মতোই অঝোর ধারায় সারাদিন বৃষ্টি ঝরছিল। বৃষ্টির পানিতে ধূলায় ধূসরিত শক্ত মাটিও নরম হয়ে দিন দুইয়ের মধ্যেই নদী-নালা,খাল- বিল,রাস্তা-ঘাট ডুবে গিয়েছিল।
অজানা আশঙ্কায় শিউরে ওঠে সেদিনও আমার মনে হয়েছিল, বিলুদের পুকুর পাড়ের প্রকান্ড কৃষ্ণচূড়া গাছটায় বিষাদময় লালেরা মেতেছিল সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে।

বিকেলবেলা একদৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে আছি,দূর থেকে ভেসে আসা মানুষের অস্পষ্ট ক্ষীণ আকুল আর্তনাদ শুনে মনে হচ্ছিল তক্ষুনি বেরিয়ে যাই। কিন্তু সে মুহূর্তে আমি যে নিরূপায়…..।
বিছানার সাথে গা এলিয়ে দিলাম। এমনসময় পাশের বাড়ির বিলু দৌড়ে এসে তন্ময় হয়ে খবর দিল- ‘আজ সারাদিন তিনজন রাজাকারের সাথে গ্রামে মিলিটারিদের গাড়ী নিয়ে ঘুরতে দেখেছে।’
বুঝতে পারলাম আর বসে থাকার সময় নাই। বাঁশবাগানের গভীর অরণ্যে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প গঠন করলাম। গ্রামের এক হাজী সাহেব আমাদেরকে তার কাচারি ঘরে জায়গা দিয়েছিলেন। আমরা মোট উনিশ জন এই ক্যাম্পে ছিলাম।
তন্মধ্যে, মাওলানা বায়েজীদ আহমেদ নজীর বিহীন এক যুদ্ধা ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই মুক্তাকী ও পরহেজগার, তার আখলাক যেমনি ছিল অমায়িক তেমনি সাহসও ছিল অসীম।
যেহেতু তার সাহস ছিল অপরিসীম সেজন্য আমরা তাকেই দলের আমীর নিযুক্ত করলাম।
সেখানে আমাদের ট্রেইনিং দিচ্ছিলেন বহরপুরের ময়না মাহমুদ ভাই।
বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন।
আমরা সেখানে ট্রেনিং নিতাম কখনো বাঁশবাগানে আবার কখনোবা হাজী সাহেবের কাচারী ঘরে। এভাবে আমরা কয়েক মাস ট্রেনিং নিলাম।

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অতঃপর আসলো সেইদিন। যেদিন আমরা সর্বপ্রথম মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলাম পাকিস্তানী ক্যাম্পে।

প্ল্যান মতো এশার নামাজের পর আমরা সবাই যার যার অস্ত্র ঠিকঠাক করে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের নিকট পজিসান মতো দাড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ আমীর সাহেব ফায়ারের নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেঁধে গেল তুমুল লড়াই। শত্রুর সংখ্যা বেশি থাকায় সুবিধা করতে পারছিলাম না। আমি ছিলাম আমীর সাহেবের পেছনে। হঠাৎ আমীর সাহেব ফায়ার করতে করতে মূল দল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলেন। আমি তাকে বাঁধা দিলাম। কারণ সামনেই ছিলো শত্রু বাহিনীর মূল আস্তানা। তিনি আমার কথায় কোন কর্ণপাত করলেন না।হঠাৎ তিনটি বুলেট এসে পরপর তার মাথায় আঘাত হানলো। তিনি সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
মাহমুদ ভাই একহাতে তার মাথাটা উঁচু করে বুকের সাথে মিলিয়ে অন্য হাতে সাড়াশি আক্রমণ চালাতে লাগলেন। আস্তে আস্তে শত্রু সংখ্যা কমতে লাগল। কেউবা নাজুক অবস্থায় মনোবল হারিয়ে পালিয়ে গেল।যুদ্ধ শেষ হলো,আমরা ক্যাম্প দখল করলাম।

কিছুক্ষণ পরেই মাওলানা বায়েজীদ আহমেদ শহীদ হলেন। তখন তার শরীর হতে এমন এক সুঘ্রাণ আসতে লাগলো, যা আমাদের সবার নিকট অপরিচিত ছিলো। ফজরের নামাযের পর তার মাথা হতে বুলেট তিনটি বের করে সেখানেই তার অন্তিম ঠিকানা রচনা করা হল।
তার জীবনের অবিস্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধের গল্প শেষ হওয়ার পর তার দিকে তাকিয়েই আমি হতবাক!মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতের সকালে শিশির কণা দূর্বা ঘাসের মাথা বেয়ে যেমনি ভাবে ঝরে পড়ে,তদ্রুপ মাওলানা বায়েজিদ আহমেদের জন্য তার এক দরদ অশ্রু হয়ে তার গন্ডদেশ ছড়িয়ে পড়ছে!

Writer: সানিয়া তোহফা

উৎসর্গঃ১৯৭১ সালের সকল বীর সূর্য সন্তানদের।🌻

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

Leave a Reply