Tag: kobita

  • সবার আমি ছাত্র – সুনির্মল বসু

    আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
    উদার হতে ভাই রে,
    কর্মী হবার মন্ত্র আমি
    বায়ুর কাছে পাই রে।
    পাহাড় শিখায় তাহার সমান-
    হই যেন ভাই মৌন-মহান,
    খোলা মাঠের উপদেশে-
    দিল-খোলা হই তাই রে।
    সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
    আপন তেজে জ্বলতে,
    চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
    মধুর কথা বলতে।
    ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-
    অন্তর হোক রত্ন-আকর;
    নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
    আপন বেগে চলতে।
    মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
    পেলাম আমি শিক্ষা,
    আপন কাজে কঠোর হতে
    পাষান দিল দীক্ষা।

  • নাবিক -জীবনানন্দ দাশ

    কবে তব হৃদয়ের নদী
    বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি!
    সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে
    দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে
    বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন!
    -পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন!
    কারাগার-মর্মরের তলে
    নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে
    ভ’রে যায় বসুধার আহত আকাশ!
    অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!
    -সহস্রের অঙ্গুলিতর্জন
    নিত্য সহিতেছি মোরা,-বারিধির বিপ্লব-গর্জন
    বরিয়া লয়েছ তুমি,- তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;
    তোমার পঞ্জরতলে টগ্‌বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!-
    তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার,
    অবগুণ্ঠিতার
    হিমকৃষ্ণ অঙ্গুলির কঙ্কাল-পরশ
    পরিহরি গেলে তুমি,-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস
    তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা
    চকিতে চূর্ণিয়া গেলে,-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা
    বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,
    তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট
    তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!
    নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!
    প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!
    ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,-
    অগাধের সাধ
    তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ!
    মণিময় তোরণের তীরে
    মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে
    নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে
    হে দুরন্ত দুর্নিবার,-প্রাণ তব কাঁদে!
    ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন,
    সমুদ্রের যৌবন-গর্জন
    তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর- শের!
    টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের
    হে জলধি পাখি!
    পক্ষে তব নাচিতেছে লক্ষ্যহারা দামিনী-বৈশাখী!
    ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রত্নচূড় ময়ূখের টিপ,
    কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ
    করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে!
    বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে
    সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে!
    কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে,-
    স্তম্ভিত নয়নে
    নীল বাতায়নে
    তাকায়েছ তুমি!
    অতিদূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের
    আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি
    সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী!
    সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি
    আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া
    হে জল-বেদিয়া!
    অলক্ষ্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন
    সিন্ধু- বেদুঈন!
    নাহি গৃহ- নাহি পান্থশালা-
    লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা
    তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্য-পাতালে-
    বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে!
    প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!
    সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছু-ডাকা স্বর,
    ভুলেছ নোঙর!
    কোন্ দূর কুহকের কূল
    লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল
    কে বা তাহা জানে!
    অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!
    ✍✍✍✍✍
    নাবিক

    • জীবনানন্দ দাশ—✍✍✍✍
  • বোধ -জীবনানন্দ দাশ

    আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
    স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
    স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
    হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
    আমি তারে পারি না এড়াতে,
    সে আমার হাত রাখে হাতে,
    সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
    সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
    শূন্য মনে হয়,
    শূন্য মনে হয়।

    সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
    কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
    সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
    কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
    কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
    কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
    সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
    সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
    স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
    শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
    শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
    উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
    চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
    কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
    স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
    মাথার ভিতরে।
    পথে চ’লে পারে—পারাপারে
    উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
    মড়ার খুলির মতো ধ’রে
    আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
    তবু সে মাথার চারিপাশে,
    তবু সে চোখের চারিপাশে,
    তবু সে বুকের চারিপাশে;
    আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।

    আমি থামি—
    সেও থেমে যায়;

    সকল লোকের মাঝে ব’সে
    আমার নিজের মুদ্রাদোষে
    আমি একা হতেছি আলাদা?
    আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
    আমার পথেই শুধু বাধা?

    জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
    সন্তানের মতো হ’য়ে—
    সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
    যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
    কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
    যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
    জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
    তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
    আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
    আমার মনের মতো না কি?
    —তবু কেন এমন একাকী?
    তবু আমি এমন একাকী।
    হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
    বাল্‌টিতে টানিনি কি জল?
    কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
    মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
    ঘুরিয়াছি;
    পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
    গিয়েছে জড়ায়ে;
    –এই সব স্বাদ;
    —এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
    বয়েছে জীবন,
    নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
    এক দিন;
    এই সব সাধ
    জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
    চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
    ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
    অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
    ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;

    আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
    আসিয়াছে কাছে,
    উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
    ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
    ভালোবেসে তারে;
    তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
    আমি তার উপেক্ষার ভাষা
    আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
    অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
    আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা

    আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
    তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।

    মাথার ভিতরে
    স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
    আমি সব দেবতারে ছেড়ে
    আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
    বলি আমি এই হৃদয়েরে:
    সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
    অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
    কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
    পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
    মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
    মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
    শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!

    এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
    পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
    পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
    চায় না সে? করেছে শপথ
    দেখিবে সে মানুষের মুখ?
    দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
    দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
    চোখে কালো শিরার অসুখ,
    কানে যেই বধিরতা আছে,
    যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
    নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে,
    যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
    —সেই সব।

  • মৃত্যুর আগে -জীবনানন্দ দাশ

    আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
    দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
    কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
    তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
    জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
    চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

    আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
    খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
    পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
    বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
    গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
    আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;

    আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
    এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
    আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত,
    সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
    শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
    আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;

    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
    হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
    ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
    চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা
    নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
    পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে;
    মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
    বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে,
    নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে,
    খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে;
    বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
    নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;

    আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল
    পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;
    যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
    পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;
    আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,
    প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ;

    আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর
    পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
    ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
    আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;
    চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:
    পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;

    আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
    সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
    ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
    নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
    কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
    শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!

  • সেদিন এ-ধরণীর

    সেদিন এ-ধরণীর
    সবুজ দ্বীপের ছায়া—উতরোল তরঙ্গের ভিড়
    মোর চোখে জেগে-জেগে ধীরে-ধীরে হ’লো অপহত
    কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো।
    দিকে-দিকে ডুবে গেল কোলাহল,
    সহসা উজানজলে ভাটা গেল ভাসি,
    অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি
    বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার।

    সেইদিন মোর অভিসার
    মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
    বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
    ভেসেছিলো আতুর উদাসী;
    বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
    কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি
    সেদিন শুনিনি তাহা;
    ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
    অতিদূর তারকার কামনায় আঁখি মোর দিয়েছিনু খুলে।

    আমার এ শিরা-উপশিরা
    চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন,
    শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন—
    মোর তরে পিছু ডাক মাটি-মা—তোমার;
    ডেকেছিলো ভিজে ঘাস—হেমন্তের হিম মাস—জোনাকির ঝাড়,
    আমারে ডাকিয়াছিলো আলেয়ার লাল মাঠ—শ্মশানের খেয়াঘাট আসি,
    কঙ্কালের রাশি,
    দাউ-দাউ চিতা,
    কতো পূর্ব জাতকের পিতামহ পিতা,
    সর্বনাশ ব্যসন বাসনা,
    কতো মৃত গোক্ষুরার ফণা,
    কতো তিথি—কতো যে অতিথি—
    কতো শত যোনিচক্রস্মৃতি
    করেছিলো উতলা আমারে।
    আধো আলো—আধেক আঁধারে
    মোর সাথে মোর পিছে এলো তা’রা ছুটে,
    মাটির বাটের চুমো শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে, রোমপুটে;
    ধুধু মাঠ—ধানখেত—কাশফুল—বুনো হাঁস—বালুকার চর
    বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
    এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া;

    মাঝপথে থেমে গেল তা’রা সব;
    শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
    দূরে—দূরে—আরো দূরে—আরো দূরে চলিলাম উড়ে,
    নিঃসহায় মানুষের শিশু একা—অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
    অসীমের আঁচলের তলে
    স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
    উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে—
    দূর ছায়াপথে।
    পৃথিবীর প্রেতচোখ বুঝি
    সহসা উঠিল ভাসি তারকাদর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি;
    ভ্রূণভ্রষ্ট সন্তানের তরে
    মাটি-মা ছুটিয়া এলো বুকফাটা মিনতির ভরে;
    সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু—বৃদ্ধ মৃত পিতা,
    সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা,
    মোর পাশে দাঁড়ালো সে গর্ভিণীর ক্ষোভে;
    মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
    কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন—জননীর প্রাণ;
    জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান
    তার তরে কালে-কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা শালতমালের ছায়া,
    এনেছে সে নব-নব ঋতুরাগ—পউষনিশির শেষে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া;
    তার তরে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
    মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার ভিজে রসে উঠিয়াছে ভরি,
    উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
    মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী;
    মশলাদরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে—
    কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু অমানিশা
    দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
    নয়ন মুদিনু ধীরে—শেষ আলো নিভে গেল পলাতক নীলিমার পারে,
    সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।

    জীবনানন্দ দাশ
    জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা

  • পিরামিড

    বেলা ব’য়ে যায়,
    গোধূলির মেঘ-সীমানায়
    ধূম্রমৌন সাঁঝে
    নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে,
    শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে;
    পান্থ ম্লান চিতার কবলে
    একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ;
    কার লাগি, হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছো আজ—
    কি এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন!
    অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
    চকিতে মিলায়ে গেছে পাও নাই টের;
    কোন্ দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
    দেউটি নিভায়ে গেছে—চ’লে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
    চ’লে গেছে প্রিয়তম—চ’লে গেছে প্রিয়া
    যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
    চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী
    কবে কোন বেলাশেষে হায়
    দূর অস্তশেখরের গায়।
    তোমারে যায়নি তা’রা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া;
    সাঁঝের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া
    মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী,
    তোরণে আসেনি তব লক্ষ-লক্ষ মরণ-সন্ধানী
    অশ্রু-ছলছল চোখে পাণ্ডুর বদনে;
    কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তা’রা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
    জানো নাই তুমি;
    জানে না তো মিশরের মুক মরুভূমি
    তাদের সন্ধান।
    হে নির্বাক পিরামিড,—অতীতের স্তব্ধ প্রেতপ্রাণ,

    অবিচল স্মৃতির মন্দির,
    আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি ব’সে আছে স্থির;
    নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে
    চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে
    মেঘরক্ত ময়ূখের পানে,
    জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে
    নূতন ভাস্কর;
    বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
    নবোদিত অরুণের সনে—
    কোন্ আশা-দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে!
    পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু-দণ্ডের রুধিরফোয়ারা—
    কী এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া!
    থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন;
    শতাব্দীর বিরহীর মন
    নিটল নিথর
    সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত পীত সাগরের ’পর;
    বালুকার স্ফীত পারাবারে
    লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে
    মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি’
    মৌন ভিক্ষা মাগি।
    খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার
    মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
    ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায়—
    বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই ব’সে আছে পিরামিড হায়।
    কতো আগন্তুক কাল অতিথি সভ্যতা
    তোমার দুয়ারে এসে ক’য়ে যায় অসম্বৃত অন্তরের কথা,
    তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল,
    তুমি রহো নিরুত্তর—নির্বেদী—নিশ্চল
    মৌন—অন্যমনা;
    প্রিয়ার বক্ষের ’পরে বসি’ একা নীরবে করিছো তুমি শবের সাধনা—

    হে প্রেমিক—স্বতন্ত্র স্বরাট।
    কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট
    উঠিবে জাগিয়া,
    সস্মিত নয়ন তুলি’ কবে তব প্রিয়া
    আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদকৃষ্ণ পাণ্ডু চূর্ণ ব্যথিত কপোলে,
    মিশরঅলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্ব’লে,
    ব’সে আছে অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই;
    ওলটি-পালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই
    জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি–প্রেমের প্রহরা।
    মোদের জীবনে যবে জাগে পাতাঝরা
    হেমন্তের বিদায়-কুহেলি—
    অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি
    গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
    দু-দিনের তরে শুধু; নবোৎফুল্লা মাধবীর গান
    মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
    নিমেষে চকিতে;
    অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
    ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে।

    জীবনানন্দ দাশ
    জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা

  • হাট

    কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি-
    বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি।
    গাড়ি চালায় বংশীবদন,
    সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন।

    হাট বসেছে শুক্রবারে
    বক্‌শিগঞ্জে পদ্মাপারে।
    জিনিস-পত্ৰ জুটিয়ে এনে
    গ্রামের মানুষ বেচে কেনে।

    উচ্ছে বেগুন পটল মুলো,
    বেতের বোনা ধামা কুলো,
    সর্ষে ছোলা ময়দা আটা,
    শীতের র‌্যাপার নক্‌শা-কাটা।

    ঝাঁঝরি কড়া বেড়ি হাতা,
    শহর থেকে সস্তা ছাতা।
    কল্‌সি-ভরা এখো গুড়ে
    মাছি যত বেড়ায় উড়ে।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • আমার আমির ব্যাখা

    কাব্যগ্রন্থঅবান্তরনীলা
    শাওন মল্লিক

    নীলা …!
    আমি চলে যাব….
    কোথাও অন্তরালে
    তোমার মধ্যে…
    আমার আমির স্বার্থহীনতার অন্তরালে
    আমি মানুষ টার সব বিষাক্ত
    তুমি আমার আমিকে. …
    তোমার অন্তরালে নিও না…
    ওখানে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা….
    আচমকা!আচমকা!
    অগ্নুৎ্পাতের উৎপত্তি…
    আচ্ছা আমার সুখগুলো কি নিতে পারবে?
    নাকি ওখানেও কষ্টের রেশ লেগে আছে?
    জীবদ্দশায় আমায় একটা জিনিস শিখেছি নীলা!
    তুমি আমায় ছাড়া ভালো থাকতে পারো না!
    আবার তুমি সবসময় ভালো থাকো এটাই যেনো আমার ইচ্ছে!
    এরমধ্যে কোনটা আমি এটা বুঝি না!
    হয়তো দুটোই আমি..!

  • সর্বাঙ্গে স্বার্থহীনতা

    সর্বাঙ্গে স্বার্থহীনতা

    #কাব্যগ্রন্থ_অবান্তর_নীলা

    #শাওন_মল্লিক

    তোমার সুখের সাথে ….
    চলছে আমার বরফের মতো শীতল স্নায়ুযুদ্ধ…
    কায়াহীন গভীর খাঁদ…
    অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতায় সৃষ্ট কম্পনের
    অনুভূতির নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর নিম্নচাপ….
    ধোঁয়া বেরুচ্ছে….
    অশ্রুসিক্ত চোখ লাল বর্বরোচিত কাঠগোলাপ…..
    কুয়াশাজড়ানো
    স্বপ্নের কথা বারবার বলে ওঠে…
    মেঘের ঝড়ে পড়া.….
    রক্তমাংসের গলে যাওয়া সময়েরই ইঙ্গিত…
    পচা গলা দেহ….
    কি দুর্গন্ধের আভাস মিলে চলেছে..
    এই মাঝ রাতে…
    আমি চলে যাবাে মৃত্যুর মিছিলের
    ওপারে….
    অশ্রুপাতে আর স্পর্শকাতর হবাে না
    তখন….
    ভীন্নতার সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
    কবিতার মহামারী আকারে ছড়িয়ে
    যাবাে একাকীত্বের গহীনে…

  • মায়াদেবী

    #কাব্যগ্রন্থ_অবান্তর_নীলা

    #শাওন_মল্লিক

    আমি এক অসম্ভব মায়াদেবীর পাল্লায় পড়েছিলাম বাপু!
    পড়েছিলাম বললে বোধহয় ভুল হয়!
    পড়ে রয়েছি অনন্তকাল ধরে..
    তার মায়া চোখের মায়া সহ্য করবো?
    সেই সহ্যশক্তিও নেই আমার!
    সে সাধ্য নেই আমার!
    সে কি যে মায়া!কি যে চাহনি!
    তার এমন মায়া যে!
    সে মায়া চোখে চোখ রাখলে
    আমায় ধমনী শিরা-উপশিরায় টান পড়ে যায় বাপু!
    টানটান রক্তে গড়া শরীর টাও কেমন জানি
    মায়াবী হয়ে যায় …
    বাতাসের তীব্র গতিতে যেনো বয়ে যায় আমি!
    আমার জরাজীর্ণ জীবনের দেবী অন্য কেউ জেনে…
    কেউ আর দেবীর রূপ ধরে….
    জরাজীর্ণ দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে…
    এই জীবন গৃহে গীতবাদ্য আর…
    আমোদ-প্রমোদ করতে আসবে না…..
    তাই বলছিলাম কি!
    আমার দেবী চলচ্চিত্রের চিন্তানন্দনতাকে বাড়িয়ে লাভ নেই..
    আমার দেবীর!
    বেলি ফুলের গন্ধ এখান অব্ধিই সীমাবদ্ধ!