মোতাহার সাহেবের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে।তিনি তার ইজি চেয়ারে চোখ-মুখ কুঁচকে বসে আছেন।তাকে দেখে প্রথম দর্শনে মনে হবে হয়ত ওনার প্রচন্ড পেট ব্যথা নয়ত বিশ্রি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন।দু’টির কোনোটিই অবশ্য নয়।তার শুচিবায়ু ধরণের স্বভাব।আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বরাবর যথেষ্ট সচেতন।স্বাস্থ্যের দিক থেকে মোটামুটি নিরোগ ও বলা যায়।তার বিরক্তির কারণ রশীদ।ছেলেটাকে তার গাধামানব মনে হয়।স্বভাব-চরিত্র থেকে শুরু করে তার কথা কিংবা কাজ থেকে ইদানীং মোতাহার সাহেব গাধার গন্ধ পান।কয়েকদিন আগে সে ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো,তাকে দেখে হঠাৎ মনে হলো একটা গাধা মানুষ হয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে ছোট চারা গাছ দেখছে।সেদিনের ঘটনা,বারান্দায় এসে লালু দেখলো রশীদ বাগানের ঘাস ছিড়ে জিবে লাগিয়ে চেটে দেখছে।এই ঘটনা মোতাহার সাহেবের কানে যাওয়ার পর তিনি যথেষ্ট বিরক্ত হলেন।রশীদকে তিনি ডেকে পাঠালেন তার রুমে।
-“রশীদ,বসো।”
-“জি বলুন বাবা।”
-“কেমন আছো?”
-“ভালোই তো মনে হচ্ছে,আপনার শরীর কেমন?”
-“সেটা আপাতত বিষয় নয়।লালুর কাছে শুনলাম ঘাস খাওয়া ধরেছো নাকি?”
-“ভুল শুনেছেন,খাই নি,খানিকটা চেটে দেখেছি শুধু।”
-“বিশেষ কোনো কারণ?”
রশীদ হাসিমুখে বলে,
-“একটা জোকস পড়েছি,ঘাস খেলে চোখের পাওয়ার ঠিক থাকে,তাই ছাগল কখনো চশমা পড়ে না।যদিও হাসির কথা তবে মনে হলো লজিকটা খারাপ নয়।ভাবলাম ট্রাই করে দেখা যাক।”
রশীদের কথা শুনে মোতাহার সাহেব তিনবার মনে মনে বলে উঠলো গাধামানব।আর বলতে খুব ইচ্ছা করলো ঈগলের চোখ সবচেয়ে প্রখর হয়,ঈগর ইঁদুর,সাপ সব পশুপাখি খায়,তুমিও খাওয়া শুরু করবো বাবা,চিড়িয়াখানার পাশে কম্বল পেতে শুয়ে থাকো।ভদ্রতার খাতিরে কথাগুলো বলা গেল না।নিজের ছেলে হলে ঠিক বলা যেতো কিন্তু মেয়ের জামাইকে এভাবে বলা যায় না।জামাইয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে হয়,সস্তা জোকে ঘর ফাটিয়ে হাসতে হয় আর ফালতু লজিকে চোখ বড় করে মাথা দুলিয়ে বুঝাতে হয় ছেলে অনেক জ্ঞানী।এখনো তাকে ভদ্রতা মেনে চলতে হবে।তিনি বললেন,
-“তোমার কাছে এটাকে ভালো লজিকে মনে হলে অবশ্যই খেয়ে দেখবে,এরপর আমাকে জানাবে কেমন লাগলো খেয়ে?”
-“জি বাবা,অবশ্যই জানাবো।যদি উপকার পাই তাহলে খানিকটা ভালো ঘাস আপনাকেও দিয়ে যাবো।”
মোতাহার সাহেব নির্লিপ্ত চেহারা করে হালকা হাসি দিয়ে রশীদের দিকে তাকালেন।যদিও তার ইচ্ছে করছিলো উঠে তাকে গালে ঠাস ঠাস করে চড় দিতে।কত বড় ফাজিল তাকে বলে কি না ভালো ঘাস এনে দিবে।রাগে চিড়চিড় করতে করতে তিনি লালুকে ডেকে বললেন এক কাপ চা করে দিতে তাকে।তার ইচ্ছা করছে তার মেয়েকে ডেকে কতক্ষণ কড়া কিছু কথা শুনাতে।তার অসম্ভব বুদ্ধিমান মেয়েটা এরকম গাধা মানবের প্রেমে কিভাবে পড়লো সেটা তার জানার খুব ইচ্ছা।
রাতে বিছানায় যাবার আগে মোতাহার সাহেব প্রত্যেকদিন কতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ান।সময়টাতে তিনি একা থাকতে পছন্দ করেন কিন্তু তিনি খেয়াল করেছেন তার মেয়ে ঠিক এই সময়টাতেই তার সাথে কথা বলতে আসে।একদিন কড়া করে তাকে বলতে হবে এই সময়ে যাতে তাকে সে বিরক্ত না করে।কিন্তু মেয়েটাকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসেন,তার সাথে কড়া করে কথা বলার সম্ভব নয়।যথারীতি আজকের নীলা আসলো ঠিক একই সময়ে।
-“বাবা, আসি?”
-“আয়।”
-“কেমন আছো বাবা?”
-“ভালো থাকার কথা ছিলো কিন্তু তোর বিখ্যাত গাধা জামাই আমার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে।শুনলাম আজকে ঘাস চেটে দেখছে।কয়েকদিন পর কি করবে?মাটিও খেয়ে দেখবে?মিনারেলস ইনটেক?”
-“হাহাহাহাহাহা।এতো রেগে যাচ্ছো কেনো বাবা?সে একটা লজিক পরীক্ষা করে দেখতে চাচ্ছে।করতে দেও,দেখোই না কি হয়?”
-“ছাগল ঘাস খায় তাই চোখের পাওয়ার ভালো এটাকে তুই লজিকে বলছিস?এসব কুলজিক।”
-“বেচারাকে তুমি দেখতে পারো না বলেন তোমার কাছে এতটা বিরক্ত লাগছে।এটা একটা ফান বাবা।”
-“একটা গাধামানবকে ভালো লাগার কিছু নেই।তুই ওকে কিভাবে ভালোবাসলি বল তো?”
-“সেটা তো বলা যাবে না বাবা।সেটা আমাদের সিক্রেট।তবে একটা কথা বলতে পারি রশীদ অসম্ভব সরল একটা মানুষ।তুমিও তাকে প্রচন্ড পছন্দ করো কিন্তু প্রকাশ করো না।”
-“আমি মোটেও তাকে পছন্দ করি না,এটা তোর ভুল ধারণা।তার সাথে যা করি সেটা নিতান্ত ভদ্রতা।”
-“বাবা আমাকে মিথ্যা বলে লাভ নেই,আমি তোমাকে চিনি।”
-“মা রে তুই ছাড়া আমাকে আর কে ই বা চিনবে বল।”
-“আচ্ছা বাবা আসি,ভালো থেকো।”
-“তুই ও ভালো থাকিস মা।আচ্ছা তোর মা আর অভ্র কেমন আছে?”
-“তারাও খুব ভালো আছে বাবা।অভ্র ভীষণ দুষ্ট হয়েছে।মা সারাদিন তার পিছনে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ক্লান্ত।আচ্ছা বাবা আসি এখন।”
-“আচ্ছা মা।”
মোতাহার সাহেব নীলার ছবির সামনে থেকে সরে এসে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণের পানিটুকু মুছে নিলো।রোজ তিনি এই সময়টাকে মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেন তার সাথে।মেয়েটি তার গত বছর প্রথম বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলো।বাবুটাকে ও বাঁচানো যায় নি।তার সাজানো জীবনটুকু নিয়ে তার ছোট্ট মেয়েটি পাড়ি দিয়েছিলো অন্য ভুবনে।
-“রশীদ।”
-“জি বাবা।”
-“তোমার ঘাসের পরীক্ষা কদ্দুর?”