“ভাইয়া, আর দু’টা দে না, দে না ভাইয়া”
“উঁহু, আর দেয়া যাবে না”
“কেন, কেন দেয়া যাবে না?”
“সকাল থেকে পাঁচটা দিয়েছি। আর চারটাতেই….। তুই আমার পকেট ফাকা করে দিবি নাকি?”
“না, না, আর মাত্র দুইটা, মাত্র দুইটা দে প্লিজ”
“না, আর দিতে পারব না আমার কাছে আর মাত্র ত্রিশ টাকা অছে”
“দে না,দে,প্লিজ,প্লিইইইজ,আমার মিষ্টি ভাইয়া, আর মাত্র দুইটা, আমার কিউট ভাইয়া”
এসব কথা শুনলে আমি আবার রাগ ধরে রাখতে পারি না।একেবারে গদগদ করে গলে যাই। এবারেও তাই হলো। ওকে দিলাম দুইটা।
ও, হ্যাঁ, লাবণ্যকে কি দিলাম তা তোমাদের এখনো বলাই হয়নি। প্রবলেম দিলাম! প্রবলেম? হ্যাঁ, প্রবলেম, মানে গণিতের প্রবলেম। ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি।
লাবণ্য আর আমার মধ্যে একটা ডিল হয়েছে। ওকে বলেছি, আমি তোকে প্রবলেম দিব। তুই সলভ করতে পারলে প্রত্যেক প্রবলেমের জন্য দশ টাকা করে পাবি। (আমাকে পল আরডসের শিষ্য মনে হচ্ছে নাকি!?) ভেবেছিলাম ও খুব একটা টাকা কামাতে পারবে না। কিন্তু আমি খাল কেটে তিমি আনলাম। (হুঁ, কুমির বললে ভুল হবে) ও প্রায় সব প্রবলেমেই আমাকে ভিখিরি বানিয়ে ছাড়ছিল। ব্যাপরটা একটু রহস্য জনক ঠেকল। ও তো এত ভালো প্রবলেম সলভার ছিল না। তাহলে? তাহলে কি হচ্ছে সেটা জানতে একদিন চুপি চুপি ওর পিছু গেলাম। গিয়ে দেখি ওর সামনে ওর সামনে তিনটা বই আর একটা মোবাইল! আমি তো রেগে আগুন, তেলে বেগুন। এভাবে মেয়েটা আমার সাড়ে-সর্বনাশ করছে! ওকে যখন একটা প্রচণ্ড ধমক দিতে যাব, তখনই কলবেল বেজে ওঠে। উফ! অসহ্য! এখন আবার কোন হতচ্ছাড়া মরতে এলো! এ যাত্রায় লাবণ্য তাই বেঁচে গেল। হয়তো তখন আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছিল, তাই আর একবারও………।
তোমাদের মনে হয় গল্পটা আর শোনা হলো না। লাবণ্য চলে এসেছে। দেখি আমার বিশ টাকা বাঁচে কি না মরে।
দুপুরে কলেজ থেকে ফিরছি। দেখলাম লাবণ্য একটা জুতার দোকানে ঢুকছে। ঘটনা কি? হবে হয়তো একটা। আমি বরং ওর জন্য দোকনটার বাইরে একটু দাঁড়াই। ওকে নিয়েই ফেরা যাবে। কিন্তু দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও যখন ওর দেখা পেলাম না, তখন দোকনটার ভিতরে উঁকি দিলাম। কিন্তু দেখলাম লাবণ্য নেই। বুঝলাম আমি যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইন্টারনেট ঘাটছিলাম তখনই ও বেরিয়ে গেছে। তাই আর অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করলাম। ভাগ্যের জোরে একটু সামনে গিয়ে আবার ওর দেখা পেলাম। কিন্তু দেখলাম ও একটা গলিতে ঢুকছে। মনে হলো যেন ও একটু জোরে জোরেই হাঁটছে। পিছন থেকে ডাকলাম। কিন্তু শুনতেই পেল না। তাই আমিও ওর পেছনে গেলাম। একটু সামনে গিয়েই বুঝলাম গলিটা বেশ উৎকট গন্ধে ভরা। গলির দুপাশে ছাপড়া মতন ঘর লাইন ধরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলাম গলিটা খুব সরু,অন্ধকার আর একেবারে ফাঁকা। লাবণ্য হয়তো কোন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু এই জায়গায় ওর কোন বন্ধু থাকে বলে তো মনে হয় না। গলিটার উৎকট গন্ধে আমার নাড়ি-ভূড়ি উল্টে আসছিল। কিন্তু তবুও আমি পা টিপতে টিপতে ওর পিছনে হাঁটছিলাম। ভাই হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না! যদি এর কোন বিপদ হয়। কিন্তু আসলে কেন যে যাচ্ছিলাম তা একমাত্র আমি জানি। অন্ধকার গলি দেখেই বুদ্ধিটা এসে যায়। আজ ওকে দিনের বেলায়ই ভূতের ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে আদায় করা প্রতিটা পায়-পয়সা সুদে-আসলে উশুল করব। এই সুযোগটা কোন ভাবেই হাতছাড়া করা যায় না। লুকিয়ে-চুরিয়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা ইটের সাথে পা বেঁধে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। কিন্তু পকেট থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল আর সেই শব্দে লাবণ্য পেছন ফিরে আমায় দেখে ফেলল। ঈশ! এত বড় সুযোগ ফসকে গেল। কিন্তু ওমা! লাবণ্য যে আমার চেয়েও বিমর্ষ! আমাকে দেখেই ভীষণ চমকে উঠল। তারপর কয়েক মুহুর্ত মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কি হচ্ছে কিছুই বুঝলাম না। তবে হঠাৎই ব্যাপরটাতে কেন যেন গাম্ভীর্য চলে এলো। এরপর লাবণ্য নীচু মাথা তুলে আমার চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করল,
“ভাইয়া, তুই খুব গণিতপ্রেমি, তাই না?”
কোথাকার জল কোথায় গড়াল? কিন্তু আমি বিস্ময়টা গোপন করে বললাম,
“হ্যাঁ, ওই একটু”
“না, একটু না, অনেকটাই। তুই খুব প্রবলেম সলভ করিস, না?”
“চেষ্টা করি একটু-আধটু”
লাবণ্য একটু উদাস হয়ে বলল,
“আমিও চেষ্টা করি”
“হ্যাঁ, সে তো করিসই”
“না, তোর ম্যাথ প্রবলেম না”
“মানে,তোকে তাহলে সত্যিটাই বলি। তুই যে টাকাগুলো আমায় দিস, আমি সেগুলো দিয়ে প্রবলেম সলভ করি”
“মানে?”
“তোর দেয়া প্রবলেমগুলো আমি নিজে সলভ করি না। বই-ইন্টারনেট থেকে দেখি। জানিস, আমাদের দপ্তরির ছেলের না,জুতো নেই”
ঘটনাটা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বুঝলাম না।
“তাই ওকে জুতো কিনে দিলাম।”
লাবণ্য আবার বলতে শুরু করল।
“তোর কাছ থেকে সকালে ষাট টাকা নিয়েছিলাম। আর আগের ছিল একশ। একশ ষাট টাকায় ভালো কোন জুতো পেলাম না। তাই এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দিলাম।”
ও একটু থামল। আবার বলল,
“গত মাসে তোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাশের বাসার বুয়াকে একটা কাপড় কিনে দিয়েছি। ওর কাপড়টা অনেক পুরনো আর ছেঁড়াও।তবুও আন্টি-আঙ্কেল একটা কাপড়ও দেয় না। শুনেছি টাকা দিতেও সমস্যা করে।
এই যে এই গলিতেই একটা বাচ্চা ছেলে থাকে। সেদিন হাতুড়ি দিয়ে ওর বাবার হাত পুরো থেতলে গিয়েছিল। তবুও ওরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিল না। কারণ কি জানিস? কারণ টাকা। ওদের টাকা নেই। আমিই টাকাটা দিলাম। ডাক্তারের কাছে নিয়েও গেলাম। সেই টাকাও তুইই দিয়েছিল। প্রবলেম সলভ করার জন্য…..”
এটুকু বলার পর একটা বাচ্চা ছেলে এসে বেশ উচ্ছ্বাস নিয়েই বলল,
“লাবণ্য আপু”
আমি তো অবাক! এটা আবার কে? লাবণ্য ওকে আদর করে ওর দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
“এই যে আলমের খুব গ্যাস বেলুনের শখ। কিন্তু একেকটার দাম পঞ্চাশ টাকা করে। তাই ওর মা কিনে পারছিল না। আমি কিনে দিলাম। সেটাও তোর টাকা দিয়েই।”
লাবণ্য একটু থামল। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ও আমাকে সুযোগ না দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, তুই আর আমি দুজনেই প্রবলেম সলভ করি। তুই গণিতের আর আমি-” লাবণ্য বাচ্চাটা আর আশেপাশের ছাপড়া ঘর গুলোর দিকে দেখিয়ে বলল,
“এদের।”
Writer: জান্নাতুল নাইম স্মরণ