“আচ্ছা দাদু, স্বাধীনতা মানে কি?”
“স্বাধীনতা মানে হলো অপরের অধীনে না থাকা। জীবনে কখনো নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন না দেওয়া।”
-এ ছিল এক মুক্তিযোদ্ধা দাদুর সাথে আমার কিছুদিন আগের কথোপকথন। দাদুর উত্তর শোনার পর আমিও নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, স্বাধীনতা বলতে আমি কি বুঝি? আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতার মানে কি?
আমার কাছে স্বাধীনতা মানে ভয়শূন্য ও আপোষহীন ভাবে বাঁচা। মানবিক আইনের অনুশাসন মেনে আর অন্যের স্বাধীনতা খর্ব না করে সম্পূর্ণ নিজের মত বাঁচতে পারাটাই আমার কাছে স্বাধীনতা। নিজের পছন্দমত নিজের কাজ করতে পারার সুযোগ থাকবে আর যেখানে অন্যদের কোন সমস্যা হবেনা, পরাধীনতা থাকবেনা, পরনির্ভরশীল হতে হবেনা, মুক্তভাবে চলার পথে কারো হস্তক্ষেপ থাকবেনা।
স্বাধীনতা আমার কাছে আকাশে উড়তে থাকা পাখির মতো। স্বাধীনতা মানে কলেজ ফেরত নির্জন পথ ধরে নির্ভয়ে বাড়ি ফেরা । স্বাধীনতা মানে বন্ধুর সাথে রাত দশটার পরেও শহরের পথে ঘোরা । স্বাধীনতার মানে হলো সত্য কথা বলা, ন্যায়ের পথে সাহসের সঙ্গে লড়াই। স্বাধীনতার অর্থ হলো ফুরফুরে মনে থাকা, স্বাধীনতার মানে হলো আলোর জীবন গড়া। স্বাধীনতার মানে হলো বাক ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। আমার মতে, স্বাধীনতা মানে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, অন্যের মতামতের গুরুত্ব দেয়া এবং নিজেও সেগুলো পাওয়া।
স্বাধীনতার অর্থ স্বেচ্চাচারীতা নয়। তবে নিজের স্বার্থকে এমনভাবে সর্বোচ্চ পরিমানে চরিতার্থ করা যেটা করতে গিয়ে অন্যের যেন সামান্যতম সমস্যা না হয়, ক্ষতি না হয়, অসুবিধা না হয়। একটা উদাহরণ দেই – গান শোনা আমার অধিকারে পড়ে, আমার স্বাধীনতায় পড়ে। কিন্তু সেই গানের আওয়াজ যখন উচ্চ হবে, গানের কথা বা অর্থ অশ্লীল হবে, আমার চারপাশের মানুষ যখন বিরক্ত বা বিব্রত হবে তখন সেই গান শোনাটা অন্যের স্বাধীনতাকে হরণ করবে। তখন সেই গান শোনা স্বেচ্চাচারিতা হবে। স্বাধীনতা মানে জোড় যার মুল্লুক তার নয়। স্বাধীনতা মানে নিজের হুকুমত কায়েম করা নয়। স্বাধীনতাকে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি ভেবে যথেচ্ছাচরিতা করা উচিত নয়।
“স্বাধীনতা বলতে খুশিমত কাজ করাকে বোঝায় যদি উক্ত কাজ দ্বারা অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা উপভোগে বাধার সৃষ্টি না হয়।”
-ইংরেজ দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসারের স্বাধীনতার এই সংজ্ঞা থেকে এটা বোঝা যায় প্রতিটা মানুষের স্বাধীনতা উপভোগের মধ্যে একটা সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করলে অন্যের স্বাধীনতা চর্চা ব্যাহত হয়। তাই স্বাধীনতা সেই পর্যন্ত উপভোগ করতে হবে যে পর্যন্ত অন্যের স্বাধীনতা ব্যহত না হয়। নিয়ন্ত্রনহীন স্বাধীনতা অরাজকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার সৃষ্টি করে। অবাধ স্বাধীনতার অস্তিত্ব কোন সমাজেই থাকতে পারে না।
স্বাধীনতা মানে স্ব অধীনতা, অর্থাৎ নিজের অধীনে চলা। স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি নিজের বিবেক আর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে, বলে দিলাম। লিখতে ইচ্ছা করছে, লিখে ফেললাম। কিছু করতে ইচ্ছা হয়েছে তো করলাম। বিবেকের কথা উল্লেখ করলাম কারণ সব ইচ্ছাই কিন্তু শোভন বা দেশ ও দশের পক্ষে উপকারী নাও হতে পারে, তাই স্বাধীনতা মানে অবাধ লাগামহীন আচরণ না, বরং মার্জিত ও রুচিশীল ব্যবহার।
আমি এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে প্রথম স্বাধীনতাটা থাকবে চিন্তার স্বাধীনতা। স্বপ্নের সেই বাংলাদেশে যে কেউ যা কিছু ইচ্ছা চিন্তা করতে পারবে; সেটা বলতে পারবে এবং সেই কথাগুলো বলার কারণে কেউ তাকে আঘাত করবে না। শত মতের শত মুনি সেই বাংলাদেশে অবাধ বিচরণ করবে, শত পথের শত পথিক সেই বাংলাদেশকে নতুন দিকে নিয়ে যাবে। সবসময় ভালো কিছুই হবে এই শর্ত না থাকলেও সেখানে সবসময় ভালো কিছু সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাটা বেঁচে থাকবে।
তরুণেরাই জাতির চালিকাশক্তি। সেই তরুণদের নিজের মতটুকু প্রকাশের সুযোগ না দিলে অনেক তরুণ তার মনের ভিতরেই বন্দি হবে। এক বিন্দু তারুণ্যের বন্দিদশাও এই দেশকে মহাকালের স্রোতে একটু করে পিছিয়ে দেবে। এই দেশ আর পেছাতে পারে না, যেকোনো মূল্যেই হোক তাকে সামনে এগোতেই হবে। ক্রিকেটে যেমন পুরো দেশ এক পতাকার নিচে জড়ো হই, চিন্তার স্বাধীনতার প্রশ্নেও পুরো জাতির এক হওয়ার সময় এসেছে।
স্বাধীনতা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি স্বাধীনতার মান রক্ষা করা। কাজেই চলুন প্রতিজ্ঞা করি যে, আমাদের স্বাধীনতা যেন অন্যের উপকার ছাড়া ক্ষতির কারণ না হয়। জয় হোক প্রজন্মের, জয় হোক চিন্তার, জয় হোক তারুণ্যের। স্বাধীনতা নামের পাখিটি নিঃশঙ্ক চিত্তে ডানা মেলুক সম্ভাবনার আকাশে। সবশেষে ছন্দাকারে বলতে চাই –
“স্বাধীনতা মানে ইচ্ছেমতো
লিখতে পারি, বলতে পারি কথা
স্বাধীনতা মানে আমার
লাল সবুজের একখানি পতাকা।”
লেখক –
তাবাসসুম মাহমুদ অর্ণব,
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়