হুমায়ূন আহমেদ, এই নামটা তো ছোটবেলায় ই শুনেছি। কিন্তু তার লেখার সাথে পরিচিতটা আমার বেশ দেরী করেই হয়েছিলো। যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি তখন থেকে হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা নিয়মিত পড়ি। প্রথম কোন বইটা পড়েছিলাম, ঠিক খেয়াল আসছে না। দুইটা বইয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছি। কিন্তু যে বইটা পড়ে তার লেখার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম, সেই বইটি হলো “নন্দিত নরকে”। এই বই পড়ার পরে বই পড়ার অভ্যাসটিকে আরো শক্তভাবে ধরে রেখেছি। ২০১৪ সালে প্রথম এই বইটি পড়ি। তারপর আর পড়িনি। কারন এই বইয়ের চরিত্রগুলোর জন্য মন খারাপ হয়। সেই কবে পড়েছি বইটা, কিন্তু রাবেয়া ও তার পরিবারের জন্য এখনও কষ্ট হয়। এখন আসি এই বইয়ের লেখনীর কথায়। আমি ভাবতেও পারিনা যে একজন মানুষের লেখক জীবনের শুরু যে বইটা দিয়ে সেই বইয়ের লেখনী এতো চমৎকার হতে পারে। একেকটা লাইন, বইয়ের চরিত্র আর ঘটনাবলী সাজানো সব কিছুই কি সুন্দর। অদ্ভুত সুন্দর করে শব্দ গেঁথেছেন। সবকিছু একদম মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি।
“নন্দিত নরকে” থেকে শুরু করে “দেয়াল” পর্যন্ত তিনি অনেক বই লিখেছেন। সব বই এখনো পড়ে উঠতে পারিনি। গল্পের যাদুকরের সব গল্পের সাথে পরিচয় এখনো হয়নি। কিন্তু যতদূর ই হয়েছে তাও কম নয়। হুমায়ূন আহমেদ এর “মেঘ বলেছে যাব যাব” বলে একটা বই আছে। কমবেশি সবাই ই বইটার কথা জানেন। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা—
“মেঘ বলেছে যাব যাব। আকাশের মেঘেরা কি কথা বলে? তারা কি যেতে চায় কোথাও? তারা কোথায় যেতে চায়? বর্ষার ঘন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে চিত্রলেখার হঠাৎ এই কথা মনে হল। দশ-বার বছরের কিশোরীর মনে এ রকম একটা চিন্তা আসতে পারে, চিত্রলেখার বয়স পঁচিশ। এ রকম উদ্ভট চিন্তা তার জন্যে স্বাভাবিক নয়। তবুও কেন জানি নিজেকে তার মেঘের মতো মনে হয়। তার কোথায় জানি যেতে ইচ্ছে করে। এ রকম ইচ্ছা তো সব মানুষেরই করে। সব মানুষের ভেতরই কি তাহলে এক টুকরা মেঘ আছে, যে কেবলি কোথাও যেতে চায়?”
চিত্রলেখা এই বইয়ের আমার খুব প্রিয় একটি চরিত্র। চিত্রলেখার মতে, “আকশের মেঘেরা কি কথা বলে? তারা কি যেতে চায় কোথাও? তারা কোথায় যেতে চায়?”- এই চিন্তাটি উদ্ভট এবং এরকম চিন্তা শুধু একজন কিশোরীর মাথায় ই আসতে পারে। কিন্তু চিত্রলেখা নিজেও জানে, এই চিন্তা উদ্ভট না। এরকম চিন্তা আমারও প্রায়ই মনে আসে। আমার মনে হয়, আরো অনেকেরও ঠিক এই চিন্তাটা মাথায় আসে। আমাদের যে এতো সুন্দর একটা আকাশ আছে, সেই আকাশের মেঘগুলো কি কথা বলে? আমি নিজেও মনে করি, সব মানুষের ভেতরেই এক টুকরো মেঘ আছে, আর সেই মেঘগুলো কোথাও যেতে চায়। মেঘগুলো কি তাদের গন্তব্য খুঁজে পায়?
হুমায়ূন আহমেদ এর লেখনীর এই হলো শক্তি, বই পড়ার সময় বইয়ের চরিত্রদের ভাবনার সাথে নিজের ভাবনা মিলে যায়। তাদের কষ্ট অনুভব হয়। অনেক সময় কিছু বই পড়ে কান্নায় গলা ধরে আসে। যেমন, “মেঘ বলেছে যাব যাব” বইয়ের চিত্রলেখা, হাসান, রীনা” এদের সবার জন্য খুব বেশি কষ্ট হয়। “নবনী” বইয়ের নবনীর জন্য বুকে কেমন একটা হাহাকার লাগে। “অপেক্ষা” এর সুপ্রভার জন্য চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। “তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে” এর নবনীর কথা পড়ে মনে হয়, মেয়েটা তো সবার মাঝে থেকেও একা। মেয়েটার এতো কষ্ট কেনো? “কৃষ্ণপক্ষ” এর অরু, মুহিব, “মীরার গ্রামের বাড়ি” এর মীরা এদের সবার জন্য প্রচন্ড মন খারাপ হয়। “বৃষ্টি ও মেঘমালা” এর হাসানের ও তার ছেলে অন্তুর জন্য ভীষণ কষ্ট হয়, মনে হয় অন্তু কেনো তার বাবার বানানো মায়ানগর টা একবার দেখতে পারলো না, সেও কেনো এলেন এর সাথে মায়ানগরের গেটের ভেতর পা দিয়ে আকাশ ফাটিয়ে একটা চিৎকার করে বলতে পারলো না- Oh my God. What is it! হাসান কেনো দিনশেষে একা হয়ে গেলো।
আবার ঠিক অন্যদিকে “বহুব্রীহি” বই পড়ে হেসে কুটিকুটি হওয়া। যখনই মন খারাপ হয়, তখন ই এই বইটা পাশে নিয়ে বসে থাকা। “সানাউল্লাহর মহাবিপদ” পড়ে হাসতে থাকা আর মনে হওয়া কেনো হুমায়ূন আহমেদ এর লেখার সাথে আরো আগে সখ্যতা হলো না। এই যাদুকর এর হাতে এমন ই শক্তি ছিলো যে, মন খারাপেও তার বই হাতে নেওয়া হয় আর মন ভালোতেও সেই তার বই ই হাতে নেওয়া হয়। তার লেখা দুটো লাইন আমার অনেক মনে পড়ে। লাইন দুটো হচ্ছে-
“দিতে পারো একশো ফানুস এনে?
আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।”
আকাশের কথা আসলো, তাই জোছনার কথাটাও বলি। তিনি আমাদের জোছনা দেখতে শিখিয়েছেন, বৃষ্টি বিলাস করতে শিখিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন —
“পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে।
শ্রাবন মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে।
সেই অলৌকিক সঙ্গীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়”
ঠিকই তো, আমরা কেউই তো সারাজীবন পৃথিবীতে থাকবো না, ফিনিক ফোটা জোছনা ও দেখবো না। শ্রাবন মাসে টিনের চালে বৃষ্টির ফোটা পড়ে যে অলৌকিক সংগীত এর সৃষ্টি হবে, তা শোনার জন্য আমরা কেউ ই সারাজীবন বেঁচে থাকবো না। সত্যি ই তো, এর কোনো মানে হয়।
হুমায়ূন আহমেদ স্যার, আপনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আপনার মায়া রেখে গেছেন। আপনার কথা আমাদের খুব বেশি মনে পড়ে। আপনি কি জানেন, আপনার বইয়ের চরিত্রদেরও আপনাকে মনে পড়ে?
” পাখি উড়ে গেলেও পালক ফেলে যায়, আর মানুষ চলে গেলে ফেলে রেখে যায় স্মৃতি” – আপনার এই কথার মতো আমাদের গল্প বলার যাদুকর হয়ে আপনি চলে গেছেন, কিন্তু রয়ে গেছে আপনার গল্পগুলো। রয়ে গেছে শুভ্র, মিসির আলী, হিমু, মুহিব, আনিস, খোকা ও হাসান সহ আরো অনেকে। রয়ে গেছে রূপা, মারিয়া, নবনী, চিত্রলেখা, কুসুম ও রাবেয়ারা। রয়ে গেছে তাদের সবার অনেক অনেক গল্প।
শুভ জন্মদিন গল্পের যাদুকর। অনেক বেশি ধন্যবাদ আপনাকে ঝুড়ি ভরা গল্প উপহার দিয়ে যাওয়ার জন্য। সুন্দর সুন্দর নাটক, সিনেমা ও গান দিয়ে যাওয়ার জন্য। একটাই আফসোস, এখন আপনার নতুন বই আর আসেনা। বই মেলায় গেলে পুরোনো বইগুলোই ছুঁয়ে দেখতে হয়। আরো একটা আফসোস আপনাকে কখনো সামনাসামনি দেখা হলো না। হুমায়ূন স্যার, আপনি যেখানেই আছেন দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুক।💚
Writer: TAUHIDA ISLAM