n the end, it’s not the years in your life that count. It’s the life in your years

— Abraham Lincoln

শেষ -জুনায়েদ ইভান

ভাদ্র মাসের সকালে হঠাৎ শিহাব একটি কঠিন সমস্যায় পড়েছে। সমস্যাটা এই যে, সে হাসানকে আত্মহত্যা করবার জন্য একটা দড়ি কিনতে পাঠিয়েছে। হাসান শার্ট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হলো। তারপর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যার পর হাতে করে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে ফিরলো ঘরে। পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট থেকে দুটো গোল্ডফিশ রেখে বললো, “এই মাছগুলোকে প্রতিদিন খাবার দিলে একটা সময় পর তারা তাদের মালিককে আলাদা করে চিনতে পারে।”
শিহাব বললো, “সেটা ঠিক আছে, তোমাকে সকালে দড়ি কিনতে পাঠিয়েছি। আজ বিকেলে পৃথিবী বরাবর তিন পৃষ্ঠার চিঠি লিখে তোমার আত্মহত্যা করবার কথা।’
হাসান শীতল গলায় বললো, “আমি আত্মহত্যা করব না।”

ভাদ্র মাসের সকালে হঠাৎ শিহাব একটি কঠিন সমস্যায় পড়েছে। সমস্যাটা এই যে, সে হাসানকে আত্মহত্যা করবার জন্য একটা দড়ি কিনতে পাঠিয়েছে। হাসান শার্ট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হলো। তারপর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যার পর হাতে করে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে ফিরলো ঘরে। পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট থেকে দুটো গোল্ডফিশ রেখে বললো, “এই মাছগুলোকে প্রতিদিন খাবার দিলে একটা সময় পর তারা তাদের মালিককে আলাদা করে চিনতে পারে।”
শিহাব বললো, “সেটা ঠিক আছে, তোমাকে সকালে দড়ি কিনতে পাঠিয়েছি। আজ বিকেলে পৃথিবী বরাবর তিন পৃষ্ঠার চিঠি লিখে তোমার আত্মহত্যা করবার কথা।’
হাসান শীতল গলায় বললো, “আমি আত্মহত্যা করব না।”

“আমি তো তোমাকে এর কারণগুলো বলেছি।”
হাসান চুপ করে থাকে ।
শিহাব ক্লান্ত গলায় বললো, “গলায় ফাঁস নিতে ভয় পেলে বিকল্প একটা
চিন্তা আছে। সুন্দর একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে মারা যেতে চাও?”
হাসান না সূচক মাথা নাড়ে ।
“বইয়ের পাতায় পটাসিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে রাখবে। পৃষ্ঠা উল্টানোর সময় আঙুল থেকে জিহ্বায় মিশে গেলেই শেষ।”
হাসান বললো,“পটাসিয়াম সায়ানাইডের এই উদ্ভট আইডিয়া আপনি কোথা থেকে পেলেন?”
“ডিটেক্টিভ বই পড়ে।”
“কিন্তু আমার আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত আপনি কেন নিবেন?”
“মানুষ কি তার সব সিদ্ধান্ত নিজে নেয়?”

“আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চান, কিন্তু সেটা আমাকে দিয়ে।”
‘আমি কেন তোমাকে মেরে ফেলতে চাইবো? এতে আমার কী স্বার্থ?”
“কিন্তু আপনি তো তাই করছেন
“পৃথিবীতে সবাই মরার জন্য আত্মহত্যা করে না। কেউ কেউ বাঁচার জন্য
করে। আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই।’
হাসান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করে, “বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে?” “কারণ মানুষ মরতে পারে কিন্তু ভুলতে পারে না।”
হাসান চুপ করে থাকে।
শিহাব বললো, “পটাসিয়াম সায়ানাইডে ভয় পেলে বিকল্প আরেকটা চিন্তা আছে । ঘুমের ভেতরে মারা যেতে চাও? স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্নের ভেতরেই অন্য একটা স্বপ্নে চলে গেলে । তারপর আর ফিরে এলে না।”
শিহাবের কথা শুনে হাসান হেসে ফেলল । বললো, “গুগলে আত্মহত্যা করার সবচেয়ে সহজ উপায় লিখে সার্চ দিলে কী আসে জানেন?”

“কী?”
“যতগুলো সার্চ রেজাল্ট পাওয়া যায়, প্রায় সবগুলোতে কাউন্সেলিং


পৃথিবীতে সবাই মরার জন্য আত্মহত্যা করে না। কেউ কেউ বাঁচার জন্য করে । কারণ মানুষ মরতে পারে কিন্তু ভুলতে পারে না । (সংগৃহীত )



সেন্টারের ফোন নাম্বার দেয়া থাকে । আর আপনি আমাকে বলছেন, মানুষ
বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে?”
শিহাব খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললো, “শব্দটা আত্মহত্যা শোনালেও এর অর্থ হবে আতাবিসর্জন।”

“আত্মহত্যাকে বলছেন আত্মবিসর্জন?”
“আমি বলিনি । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। কাদম্বরী দেবী সুইসাইড করার পর লিখেছেন, যে আত্মবিসর্জন করতে পারে, আত্মার উপর শ্রেষ্ঠ অধিকার শুধু তারই জন্মাতে পারে।”
শিহাবের সাথে হাসানের পরিচয় বছর দুয়েক আগে। রাস্তার দেয়ালে রুমমেট আবশ্যকের বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করে হাসান। দু’ঘরের একটা বাসা। একটা কিচেন, একটা বাথরুম । তারপর সবকিছু চলছিল যেভাবে চলার কথা। শিহাব অবিবাহিত মানুষ । হাসানকে জিজ্ঞাসা করে, “বিয়ে করেছো?” হাসান জবাব না দিয়ে বলে, “আমরা বরং ব্যক্তিগত আলাপ না করি।” তবু নিতান্ত কথার প্রসঙ্গ ধরে একদিন জানা গেল হাসান বিবাহিত। তার স্ত্রী বছর দুয়েক আগে তাকে ফেলে চলে গেছে। শিহাব জিজ্ঞাসা করে,
“ডিভোর্স?”
হাসান বলে, “আমরা বরং ব্যক্তিগত আলাপ না করি ।”

শিহাব রাত জেগে লেখে। একদিন হাসানকে জিজ্ঞাসা করে, টেবিল
ল্যাম্পের আলোয় তার অসুবিধা হয় কি না।
হাসান জবাব দেয়, “সমস্যা হলে কি আর লিখবেন না?”
শিহাব অবাক হয়ে বললো, “লিখব।”
“তাহলে প্রশ্ন করলেন কেন?”
‘সেক্ষেত্রে আমি বসার ঘরে গিয়ে লিখব।” 66
“মানুষের তুচ্ছ সমস্যাকে এত গুরুত্ব দেন কেন?”
“মানুষকে না, আমি আমাকে গুরুত্ব দেই। কারো সমস্যা হলে লিখতে
অসুবিধা হয় ।”
“কিন্তু আপনি বসার ঘরে গিয়ে লিখলেও আমার সমস্যা হবে।”
শিহাব জানতে চায়, “কীরকম?”
“একটা মানুষ আমার জন্য নিজের বিছানায় চিত হয়ে লিখতে পারছে না,

এই ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে ঘুম আসবে না ।

“তাহলে কী করতে পারি?” বললো শিহাব ।
“কিছু করার কথা আসছে কেন? আমি তো বলিনি, আলোতে আমার সমস্যা আছে। তবে নিতুর সমস্যা হতো। সে যখন ঘুমাতো, কবরের মতো অন্ধকার করে ঘুমাতো, যেন শরীরের আলোই একমাত্র আলো।”
“নিতু কে?”
“আমার স্ত্রী।”
শিহাব চুপ করে থাকে। ‘তার স্ত্রী এখন কোথায়’ জানতে চাওয়া সমীচীন হবে কি না ভাবে। হাসান বিছানা থেকে উঠে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে হাত দিয়ে ধোঁয়া তাড়ালো কিছুক্ষণ। বোধহয় সে খুব আয়োজন করে কিছু বলতে চাইছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, যেখান থেকে গল্প শুরু হয়, তার আগে গল্প থাকে । আর, যেখানে শেষ হয় তার পরও গল্প থাকে ।
হাসান কোথা থেকে শুরু করবে সেটা চিন্তা করার জন্য একটু সময় নিলো ।

হাসান কোথা থেকে শুরু করবে সেটা চিন্তা করার জন্য একটু সময় নিলো । তারপর বিছানা থেকে উঠে বসে শিহাবের চোখে চোখ রেখে তাকালো । কেউ চোখে চোখ রাখলে শিহাবের তাকে বুঝতে খুব সুবিধা হয়। চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষ মিথ্যে বলতে পারে না, কথাটা আসলে ঠিক না । মিথ্যে বলতে পারে, তবে সেটা তার চোখে ধরা দেয়।
শিহাব জিজ্ঞাসা করলো, “নিতু কোথায়?”
হাসান দেয়ালে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করে, “অনেক বছর আগে আমরা দুজন ট্রেন থেকে একটা ভুল স্টেশনে নেমে গিয়েছিলাম । তখন শ্রাবণ মাস । থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি । নিতু হাতে করে বিশাল আকৃতির সুটকেস নিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলো ।
একে তো বৃষ্টি, তার উপর ভোর। কাছাকাছি কোনো মসজিদের মাইক থেকে আজানের শব্দ। যে কয়টা অটো রিকশা দেখা যাচ্ছে, চালক গায়ে পলিথিন পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছে। ট্রেনে পরিচয়ের সুবাদে ভদ্রতা করে বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, আলো ফুটুক।

নিতু বললো, “আলো ফুটলে কী হবে?”
“এখন কোনো রিকশা-সিএনজি কিছু পাবেন না ।”
মফস্বলের প্ল্যাটফর্ম। অন্ধকার রেললাইন । অপরিচিত দুটো মানুষ একটা

বৃষ্টিকে কেন্দ্র করে বসে আছি। তখনো দুএকটা হকার দিকবিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিতু ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলো। কবি শেলির কবিতার বই ।

“কেন জন্ম ও মৃত্যু, স্বপ্ন এবং ভয় ফিরে ফিরে আসে এই পৃথিবীর আলোয় এমন অন্ধকার, মানুষ কেন এমন করে পায়? প্রেম আর ঘৃণা, হতাশা আর আশায়?”
নিতুর হাতে কবি শেলির বই দেখে আমি বললাম, “মারা যাবার সময় কবির জ্যাকেটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল সফোক্লিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ইডিপাস।”
সম্ভবত ট্রেনে অচেনা এক আগন্তুকের কাছ থেকে এরকম একটা কথা সে আশা করেনি। এই প্রথম নিতু আমার দিকে ভালো করে তাকালো। তারপর বিস্মিত হয়ে বললো, “কী নাম আপনার?”
বললাম, “হাসান । ”
“আমার তো এখন ইডিপাস পড়তে ইচ্ছে করছে। জানি না কবি শেলি বইটা পড়ে শেষ করতে পেরেছিল কি না।”

আমি তাকে ইডিপাসের গল্প বলতে শুরু করলাম। থিবস নগরের রাজা ইডিপাস । তিনি একদিন প্রচণ্ড অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেবতার অভিশাপে পিতার হত্যাকারী এবং মায়ের শয্যাসঙ্গী হন।
নিতু মন খারাপ করে থিবস নগরের রাজা ইডিপাসের গল্প শুনছে। “দেবতার এই বাণীর কথা ইডিপাসের পিতা রাজা লাসও জানতেন। তাই তিনি ইডিপাসকে হত্যা করার জন্য এক মেষপালককে দায়িত্ব দেন কিন্তু সেই মেষপালক তাকে হত্যা না করে অন্য এক মেষপালকের হাতে তুলে দেন। ঘটনা চক্রে ইডিপাসের ঠাঁই হয় অন্য এক দেশের নিঃসন্তান রাজা পলিবাসের হাতে। একটু একটু করে বড়ো হতে শুরু করে ইডিপাস। তারপর একদিন সেও শুনলো সেই দেবতার কথা, তুমিই হবে পিতার হত্যাকারী এবং মায়ের শয্যাসঙ্গী!”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিতু জিজ্ঞাসা করলো, “দেবতার অভিশাপ এরকম
কেন হবে?”

প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি বেড়ে চলেছে। আমরা দুজন অপরিচিত মানুষ আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করছি। এর ভেতরে ইডিপাসের গল্প আমাদের কোথায় যেন নিয়ে গেল । এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি বোধহয় এই মানুষটাকে খুঁজেছি। নিতু দেখতে শ্যামলা। কেমন যেন হলদে হলদে গায়ের রং ।
আলো ফোটার পর আবিষ্কার করি, আমরা দুজন ভুল স্টেশনে নেমে পড়েছি। বিশাল আকৃতির সুটকেস নিয়ে নিতু বেশ অস্থির হয়ে উঠলো । আমার দারুণ লাগছিল ।
কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন ঘটে তখনই বুঝতে পারা যায়, এই মুহূর্ত গুলো জীবনে থেকে যাবার জন্য এসেছে। যদি স্টেশন ভুল না হতো? যদি রিকশাওয়ালা পলিথিন প্যাচিয়ে না ঘুমোতো! যদি ঠিক সেই সময় কবি শেলির উপস্থিতি না ঘটতো? ‘এতগুলো ভুল’, ‘এতগুলো যদি’ একটার পর একটা
সিকোয়েন্স মিলিয়ে কেন সামনে এলো?

সেদিনের সকালটাকে মনে হয়েছিল, এর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই । গন্তব্য
নেই । জীবন ও জগতের এ এক আশ্চর্য রকমের মোহ।
নিতুকে বললাম, “সকাল আটটায় একটা লোকাল ট্রেন থামবে। সেখানে উঠে পরের স্টেশনে নেমে যাবো আমরা। 99
মাঝের সময়টা বসে ছিলাম প্ল্যাটফর্মে। জিজ্ঞাসা করলাম, “খিদে
পেয়েছে?”
নিতু না সূচক মাথা নাড়ে ।
“এদিকে আগে আসা হয়নি বুঝি?”
নিতু চুপ করে থাকে। কোথায় কীরকম একটা বিভীষিকার ছাপ তার চোখে-মুখে ।
বললাম, “আমি অফিসের একটি কাজে এসেছি। সপ্তাহখানেক থাকবো।” নিতু বললো, “আমি পালিয়ে এসেছি। কতদিন থাকবো জানি না।” বলেই
ব্যাগ থেকে কবি শেলির বইটি বের করে পড়তে শুরু করে।
“তুমি বছরের শেষ গীত
তার শব-মিছিলের শোকার্ত সঙ্গীত
এই শেষ অন্ধকার রাত
বছরের কবর গৃহের অর্ধ-গোলাকার ছাদ”

নেহাত কথার প্রসঙ্গ ধরে ব্যক্তিগত আলাপের যে গল্প, সেই গল্পের হাত ধরে একদিন শিহাব সিদ্ধান্ত নেয়, হাসানকে সে আত্মহত্যা করতে বলবে । তারপর দিনের পর দিন হাসানের সাথে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা কম হয়নি। এমতাবস্থায় একদিন এক সমঝোতা হয় তাদের মাঝে । হাসান সম্মতি জানিয়ে বলে, চলে যাবার আগে পৃথিবী বরাবর কিছু লিখে যেতে চায় । সেই চিঠি শেষ করে হাসান আত্মহত্যা করবার জন্য দড়ি কিনতে ঘর থেকে বের হয়। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায় সে ফেরে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে। সে আত্মহত্যা করবে না ।

sesh zunayed evan pdf



What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

Leave a Reply