It is during our darkest moments that we must focus to see the light.

— Aristotle

বৃষ্টিভেজা দিনটি

সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। নতুন নতুন ms-word app নামিয়ে নিয়েছিলাম। মোবাইল ফোনে হালকা মিউজিক এর গান শুনছিলাম। আলত বাতাসের ছোঁয়া কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছিল। লেখালেখির ইচ্ছে ছিল ছোটবেলা থেকেই। কিভাবে লেখক এর ভাষা পাঠকের মনে মাঝে জায়গা করে নিবে, তার ধারণার পরিবর্তন হয়েছে ধীরে ধীরে।
যাইহোক দিনটি ছিল – মঙ্গলবার। সকালে বৃষ্টির আভাস পেয়ে ঘুড়ি নিয়ে বাতাসের উদ্দেশে বের হলাম। বৃষ্টির আভাস থাকার কারণে কেন জানিনা সামান্যতম বাতাসও ছিলনা আকাশের বুকে। কি আর করার পর তার পাশেই বানানো বাশের বেঞ্চে 30 থেকে 40 মিনিট বসে রইলাম। একবার এক দমকা হাওয়ার স্পর্শে ভেবেছিলাম সাধের ঘুড়িটি এবার বুঝি আকাশের শেষ সীমানা তে পাড়ি জমাবে। চেষ্টার কোন ত্রুটি রইলো না, সাধের ঘুড়ি টির এবার বুঝি আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। বাড়ির দিকে রওনা দিলাম, বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ অপেক্ষা মাত্র, আকাশ বুঝি ভেঙে ঝপ ঝপ, ছপ ছপ করে জলের ফোঁটা পড়তে লাগলো। বৃষ্টির তীব্রতার মাত্রা এত বেশি যার ফলে মোবাইল ফোনের গানের শব্দটাও শোনা যাচ্ছিল না। একনাগাড়ে 20 থেকে 25 মিনিট বৃষ্টি হওয়ার পর, এবার বুঝি সূর্যি মামা দর্শন দিল।
সেদিন বিকেলবেলা- লাল রংয়ের টুকটুকে সূর্য মামাকে দেখে মনে হচ্ছিল না, দিনটিতে বৃষ্টির মেঘাচ্ছন্ন প্রদীপের আলতু আঘাত ছিল। সকলেই যে যার যার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাচ্চাদের খেলাধুলার চিৎকারে – চেচামেচিতে মুগ্ধ করা বিকেল। বটতলার দিকে দু’পা হেঁটতেই পিছন ফিরে দেখি দাদুভাইয়ের চিৎকার। আমার দাদুর নাম ছিল

নারায়ন চন্দ্র রায়। পাখি বুঝি তার নতুন ঝাঁ-চকচকে শার্টের ওপর ইয়ে করে দিয়েছে। আমি তা দেখে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। এই বুঝি, আমারও নতুন গেঞ্জিতে ইয়ে করে ফেলবে।
উপরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ এক পথিক ধমকের সুরে বলল, উপরের দিকে তাকিয়ে আছ কেন? রাস্তায় গাড়ি উপর দিয়ে চলে যাবে আমি থতমত খেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাটের দিকে যেতে লাগলো। মনের ভিতর পাখির ভয়টা কখন যে উবে গেল, ভুলেই গেলাম। হাটের গুমগুম আওয়াজে মনটা কেমন করে উঠলো। জিলিপির কেজিখানেক কিনে রওনা দিলাম, এমন সময় শুনলাম হাটের সকলেই চিৎকার করছে। কি হলো সবার আবার, আকাশের দিকে তাকিয়ে বিশমিত হয়ে গেলাম। সূর্যমামার তেজের উপর মেঘের ছায়া দেখে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম। আমি বাড়ির দিকে রওনা হচ্ছিলাম, কিছুদুর যাওয়ার পর দাদুর দেখা।
দাদুভাই বলল – জিলেপি কত দর রে।
আমি বললাম – 30 টাকা কেজি। দাদুভাইকে বললাম, ঝড় আসছে চলো বাড়ি চলে যাই।
দাদু দু’বার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, এ ঝড় খানিকক্ষণের, তুই বাড়ি গিয়ে ছাতা বাড় করগে। আমি মজনু মিয়ার চায়ের দোকান থেকে ঘুরে আসি।
কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগলাম। দমকা হাওয়া তীব্রতা এত বেশি মনে হচ্ছিল এই বুঝি উড়ে যাব। বাড়ির পাশের সেই বটতলার নিচে আসতেই দেখলাম,
শালিক পাখির বাসা ভেঙে মাটিতে লুটু পুটু হয়ে আছে। বাসার ঠিক পাশেই দুটি ছানা পড়ে আছে। দেখলাম বটগাছটি পাগলা হাতির মতো মাথা নাড়াচ্ছে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনের গাছটি থেকে বড় ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল। দেখতে পেলাম বাড়ির পথটি একটি গাছের গুড়ি কত সহজেই আটকে দিতে পারল।
ছোটবেলা থেকে আমার পাখি পালন করার ইচ্ছে ছিল। পাখির দুটিকে পেয়ে ভেবেছিলাম পাখির দুটি নিয়ে লালন পালন করব। পাখিদের গায়ে হাত দিতে দেখলাম,পাখির গাঁ ইতিমধ্যেই অনেক ঠান্ডা হয়ে গেছে। আলতো ছোঁয়ায় হাত দিতেই দেখি পাখি দুটি বুঝি আর বেঁচে নেই। পাশের বটতলা এক ফাঁকে পাখির দুটিকে রেখে, ঘন ঝোপঝাড় পেরিয়ে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি এসে দেখি কবুতরের দল আমাদের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। দেখে অনেকটা ভালো লাগলো। ঝড়ের বেগের সাথে তাল মিলিয়ে গাছের উচ্চতম ডালগুলো কটমট করে ভেঙে পড়ছে। ঘরের ভিতরে ঢুকে শুনতে পেলাম, আম পড়ার ধুপ ধাপ আওয়াজ। অন্ধকার রাত্রি, নেমেছে আকাশ – ছাতার হাতটি ধরে, আম গাছের নিচে আম টুকছি। অন্ধকার রাত্রি, বজ্রপাতের কারণে লোডশেডিং – সামান্য টর্চের আলোতে যা দেখলাম তাতে আমি হতবা। বাতাসের তীব্রতা মাত্রা এত বেশি, বড় বড় ডালপালা কটমট করে ভেঙে পরছে। তাড়াহুড়া করে ঘরে চলে এলাম। আজ বুঝি ঝড় থামছেই না।
আষাঢ় মাসের প্রথম সাত দিনকে সাত কন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দাদু ভাইয়ের কাছে শুনলাম- আজ সপ্তম দিন। তাই আজকের দিনে বৃষ্টির প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টির রাজকন্যারা এদিনের বাপের বাড়ি ত্যাগ করে শ্বশুর বাড়ি যায়। এজন্য আষাঢ় মাসের প্রথম সাত দিন বৃষ্টি তীব্রতার মাত্রা থাকে প্রতাপশালী।
পরদিন ভোর বেলা – সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আমিও উঠে বাইরে হাঁটছিলাম। সূর্যের সাত রঙের টুকটুকে আলো আমার গায়ে এসে পড়ছিল। পূর্ব দিকে সূর্য মামার বেগের সাথে তাল মিলিয়ে সকল পশুপাখি, জীবজন্তু, গাছপালা প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ সকলেই এক নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে।
সকাল হতেই আমিও সকলের মতো বের হয়ে গেলাম পায়চারি করতে। বটতলা সামনে রাস্তাটি ভাঙ্গা ডালপালার কারণে বন্য ঝোপের মত দেখতে লাগছে। কালকে রেখে আসা শালিক পাখির ছানা দুটি কথা মনে পড়ল। বটগাছের অটো কোটর কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম, পাখি দুটি নেই মনে মনে ভাবলাম পাখি দুটি উড়ে গেছে হয়তো। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হল। প্রতিবেশী বন্ধুদের কাছে শুনতে পেলাম আষাঢ়ের ঝড়ের প্রকোপ এ পাশের এলাকায় জল বেড়ে চলেছে। অনেক মাস পর বর্ষা আসছে, নতুন জল দেখার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে দেখা পাওয়া হচ্ছিল না।
তারও কিছুদিন বাদে- বাহ্যিক কারণে প্রায় অনেকদিন আষাঢ়ের ঘন বর্ষার বর্ষণের মোহর আমাকে আগ্রাস করতে পারেনি। বাহিরের কাজ শেষে বাড়ি ফিরছি কিন্তু কই বাড়ির বটগাছ দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু রাস্তা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। মোবাইল ফোনটি হাতে নিতে দেখলাম ওপারে বাবা মশাই নৌকা নিয়ে হাজির। জলের ছোট ছোট ঢেউ যেমন সুন্দর তেমনি মারাত্মক বটে। বাবা বললেন- কয়েক ঘন্টা আগে পাশের পাড়ার দুই কি তিন বছরের শিশু জলের তোড়ে ভেসে গেছে। সকাল থেকে সকলেই অনেক খোঁজাখুঁজি করছে ,উদ্ধারকর্মীরা খোঁজ চালাচ্ছে। ভাবলাম জায়গাটা দেখতে যাব, ভাবনার শেষে বাড়ি চলে এলাম। সকলেই আমাকে দেখে খুশি হলো, খাওয়া-দাওয়া করে তৈরি হয়ে গেলাম। একটি নৌকায় চার কি পাচ জন বন্ধু মিলে রওনা দিলাম। নৌকায় বসে মেয়েটার কথা ভেবে খারাপ লাগছিল। বন্ধুদের সাথে দারবেয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি হাজারো লোকের সমাগম।
আমরা ওখানে গিয়ে নদীরপাড় খানি দেখছি হঠাৎ মৃদু মৃদু ঝিরঝির বৃষ্টি নামছে। কিছু সময়ের মধ্যে বৃষ্টির তীব্র গতিতে নামতে লাগলো। পাশের চায়ের দোকানটা আজ শত শত লোকের ভিড়, আমরাও গেলাম সেখানে মানুষ বলাবলি করছিল, বাচ্চাটি বুঝি পাওয়ার কোন আশা নেই। শুনতে পেলাম খেলতে গিয়ে বল জলে পড়ে যায়, মেয়েটির বল আনতে গিয়ে নিজেই চলে গেল অচেনা দেশে। সৃষ্টিকর্তার লীলা বোঝা আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব নয় তিনি আমাদের নিজস্ব নিয়মে পরিচালনা করেন। সেদিন সন্ধা রাত্রিতে বাড়ি ফিরলাম। টুটুল কাকার কাছে শুনলাম ভগবানের অশেষ কৃপায় মেয়েটি উদ্ধার হয়েছিল। কোন একটি নদীর পাড়ে মেয়েটিকে পাওয়া গিয়েছিল। তাই বর্ষা আসলেই অজানা ভয় আমার হৃদয়কে ভীত করে।
সমাপ্ত

Sudipta Ray

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

Leave a Reply